1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নেতাজি-অনুষ্ঠানেও জয় শ্রীরাম!

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
২৫ জানুয়ারি ২০২১

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সরকারি অনুষ্ঠান। সেখানেই উঠল 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি।

https://p.dw.com/p/3oMrk
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজির জন্মবার্ষিকী পালনের অনুষ্ঠানে 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি ওঠে। ছবি: Sirsho Bandopadhyay/DW

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে মঞ্চে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সামনে অভ্যাগতরা। সঞ্চালক বলতে ডাকলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। অমনি দর্শকদের একাংশ থেকে ধ্বনি উঠল, 'জয় শ্রীরাম'।  ক্রুদ্ধ মমতা বললেন, ''এটা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি নয়। সরকারি অনুষ্ঠান। তার শালীনতা থাকা উচিত। কাউকে আমন্ত্রণ করে তাঁকে বেইজ্জত করা অন্যায়। প্রতিবাদে আমি কিছু বলব না। জয় বাংলা। জয় হিন্দ।''

এ কথা বলেই মমতা পোডিয়াম থেকে চলে যান। তিনি মঞ্চে ছিলেন। ততক্ষণে অনুষ্ঠানের তাল বেশ কিছুটা কেটেছে। এরপর প্রধানমন্ত্রী বলতে উঠেছেন। তখন আর 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি শোনা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে স্লোগান-প্রসঙ্গ তোলেননি। তার আগে ও পরে 'জয় শ্রীরাম' বলতে কাউকে দেখা যায়নি।

কিন্তু এরপর শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে, নেতাজির ১২৫তম জন্মশতবার্ষিকীর সরকারি অনুষ্ঠানে এই স্লোগান ওঠা কি উচিত? সরকারি অনুষ্ঠানের মধ্যে কি রাজনৈতিক বিষয় আসা উচিত? দুটি প্রশ্নেরই এককথায় জবাব, না। আর সরকারি অনুষ্ঠানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ দোষের হলে, সেটা নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য সরকারের অনুষ্ঠানে হয়ে থাকে।

প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে স্লোগান দেয়া অন্যায় নয়। সেই স্লোগান যদি হয়, জয় হিন্দ। সেই স্লোগান হতেই পারে নেতাজি জিন্দাবাদ বা সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে জড়িত বা নেতাজির বলা কোনো কথা। বিজেপি ১৯৮৯ সালে হিমাচল প্রদেশের পালানপুর অধিবেশনে রামমন্দির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধন্ত নেয়। তারপর থেকে 'জয় শ্রীরাম' হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের রাজনৈতিক স্লোগান। অর্থাৎ, 'জয় শ্রীরাম'  ধর্মীয় ধ্বনির থেকেও বিজেপি-র স্লোগান হিসাবে বেশি পরিচিত হয়। মিটিং, মিছিল থেকে সংসদ পর্যন্ত বিজেপি নেতারা এই স্লোগান ব্যবহার করেছেন। ফলে তা এখন তাঁদের রাজনীতির সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে।

গত লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন গাড়িতে যাচ্ছিলেন, তখন বিজেপি-র কর্মী ও সমর্থকরা 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান দেন। মমতা গাড়ি থেকে নেমে অগ্নিমূর্তি হয়ে এই স্লোগান দেয়ার জন্য তাঁদের চিৎকার করে বকতে থাকেন। যেন তাঁরা কোনো গর্হিত কাজ করে ফেলেছেন। বিজেপি-র পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন মমতা। 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান নিয়ে মমতার এই আচরণের প্রচার ভালোভাবেই করেছিল নরেন্দ্র মোদীর দল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হিন্দু-বিরোধী বলে প্রচার চালাতে তাঁদের কোনো অসুবিধা হয়নি। এর প্রভাব ভোটব্যাঙ্কে পড়েছিল বই কী।

এবারও বিজেপি একই চেষ্টা করছে। কিছুদিন আগেও মমতাকে লক্ষ্য করে 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি দেয়া হয়ছিল। তবে তখন মমতা শান্ত থেকে তা উপেক্ষা করেছেন। তাই সম্ভবত আবার একই ফাঁদ পেতেছিল বিজেপি। নাট্যকর্মী কৌশিক সেনের মতো অনেকেরই মনে হচ্ছে, এটা পূর্বপরিকল্পিত। কৌশিকের মতে, এর ফলে সুভাষচন্দ্রের অনুষ্ঠানের মর্যাদাহানি হয়েছে।

এই অনুষ্ঠানে 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি ওই একবারই উঠেছিল। মমতা বলতে ওঠার সময়। বাকি সময় ওঠেনি। তাই এই ধারণা হওয়া স্বাভাবিক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উসকে দিতেই এই কাণ্ড করেছে বিজেপি। আর মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতা দেননি। সামান্য কয়েকটি কথা বলে বসে পড়েছেন। তারপরেই বিজেপি-র প্রচার শুরু হয়ে গেছে। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, যাঁরা জয় শ্রীরাম স্লোগানকে ভয় পান, তাঁদের রাজনীতি করাই উচিত নয়। তাঁর সাফ কথা, দিদি জয় শ্রীরাম শুনলেই রেগে যাচ্ছেন। খেপে লাল হয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ, লোকসভা নির্বাচনের আগের প্রচার আবার নিয়ে এসেছে বিজেপি। তবে এবার বিজেপি-র প্রচারের নিন্দা হচ্ছে অনেক বেশি। কারণ, এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে নেতাজিকে নিয়ে সেন্টিমেন্টও জড়িয়ে আছে। যে নেতাজির ভাবনাচিন্তা, ধ্যানধারণার সঙ্গে 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি মেশে না।

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে।ছবি: privat

দিলীপ ঘোষেরা এই প্রচার করবেন সেটা সহজবোধ্য। কিন্তু তার জন্য নেতাজির ১২৫ তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি, তৃণমূল দুই দলই নেতাজিকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। সেটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। কিন্তু তার আগে নেতাজির চিন্তা, ভাবনা, চেতনার বিষয়েও তো জানতে হবে। আর তাঁকে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মূল অনুষ্ঠানে এই স্লোগান উঠবে কেন? এমনকী যিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম কট্টর সমালোচক, সেই অধীর চৌধুরীও বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীকে এইভাবে অপমান করা মেনে নেয়া যায় না।

সরকারি অনুষ্ঠানে রাজনীতির প্রবেশের ঘটনাও এখন জলভাত হয়ে গছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন নিয়মিত জেলা সফর করেন। সেখানে প্রশাসনকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। তাতে দলের নেতারাও সমস্যার কথা তোলেন। মমতা তা সমাধানের জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এনিয়ে বিরোধী নেতারা অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন তুলছেন, কেন সরকারি অনুষ্ঠানে এভাবে তৃণমূলের নেতারা থাকবেন? এটা তো কোনো রাজনৈতিক বৈঠক নয়। দরবার হলে তা জনতার দরবার হওয়া উচিত। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম মনে করেন, আশা করা যায়, মমতাও এরপর সরকারি মঞ্চকে দলের কর্মসূচির কাজে ব্যবহার করবেন না।

তাই বিজেপি, তৃণমূল সহ সব দলের নেতাদের কাছে আবেদন, দয়া করে এই লক্ষ্মণরেখাটা মেনে চলুন। সরকারি অনুষ্ঠানের, মনীষীদের জন্মবার্ষিকী বা স্মরণ অনুষ্ঠানে দয়া করে নিজেদের রাজনৈতিক স্লোগান পরিহার করুন। সব বিষয় নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করুন। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, নেতাজিদের নিয়ে না হয় রাজনীতি নাই বা করলেন! তাঁদের এবং সরকারি অনুষ্ঠানকে রাজনীতির বাইরে রাখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। গণতন্ত্রে কিছু সুস্থ রীতি আছে। সেটা মেনে চললে দেশের মঙ্গল। আর তা সমানে লঙ্ঘিত হলে গণতন্ত্রের শিকড়টাই আলগা হবে।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷