পড়ুয়াদের ট্যাবের টাকা কোথায় গেল?
১২ নভেম্বর ২০২৪তরুণের স্বপ্ন প্রকল্পে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য ট্যাব বা স্মার্টফোন কেনার টাকা দেয়া হয়েছে আগেও। গত মাসে, পুজোর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, চলতি বছরে একাদশের পড়ুয়ারাও এই অনুদান পাবে। তিনি জানান, প্রায় ১৬ লক্ষ ৪৬ হাজার পড়ুয়াকে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ১০ হাজার টাকা পাঠানো হবে। এ জন্য সরকারের খরচ হবে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এই অনুদান ব্যাংকে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হতে সামনে এসেছে অনিয়ম।
ট্যাবের টাকায় গরমিল
অন্যান্য বারের মতো এবারও সরকারের পক্ষ থেকে টাকা ছাড়া হতে থাকে পড়ুয়াদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এরপরই অভিযোগ উঠতে শুরু করে, ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশের কাছে সেই টাকা পৌঁছচ্ছে না। একের পর এক জেলা থেকে অভিযোগ আসতে থাকে।
ঝাড়গ্রাম জেলার ১১টি স্কুলের ৫০ জনের মতো পড়ুয়া অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাদের টাকা অন্যত্র চলে গিয়েছে। মালদাতেও একই অভিযোগ। হরিশ্চন্দ্রপুরের একটি মাদ্রাসায় বহু পড়ুয়ার ট্যাবের টাকা অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। জেলার শিক্ষা কর্তা একাধিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নামে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ নিয়ে তদন্ত চলছে।
কোথাও যেমন পড়ুয়ারা টাকা পায়নি, তেমন কোথাও কোথাও একাধিকবার অনুদান পেয়েছে এক একজন পড়ুয়া। মুর্শিদাবাদের ১৭টি স্কুলের প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর কাছে দুইবার টাকা পৌঁছেছে। জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছেন, কীভাবে একাধিকবার টাকা চলে গেল।
এর পিছনে কোনো চক্র আছে কি না তা জানতে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে চার জনকে।
পুলিশ মালদার বৈষ্ণবনগর থেকে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ধৃত হাসান শেখ সাইবার ক্যাফে চালান। সোমবার গভীর রাতে পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ মালদায় হানা দিয়ে হাসানকে তার বাড়ি থেকে পাকড়াও করে।
উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া ও ইসলামপুর থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধৃতদের নাম সাদিক হোসেন ও মোবারক হোসেন। এদের বাড়ি চোপড়া থানার দাসপাড়ায়। অপর ধৃত আশরাফুল হোসেনের বাড়ি ইসলামপুর থানার রামগঞ্জে।
অনুদান পাঠানোর প্রক্রিয়া
লক্ষ্মীর ভান্ডার বা বার্ধক্য ভাতার মতো সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে সাধারণ মানুষ সরাসরি নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পেয়ে থাকেন। তরুণের স্বপ্ন প্রকল্পেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে রাজ্য সরকার।
প্রতিটি স্কুল বা মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীকে নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে সংশ্লিষ্ট স্কুল বা মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হয়। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরপ্রধান শিক্ষক যাবতীয় নথি খতিয়ে দেখে পড়ুয়ার আবেদনে স্বীকৃতি দেন।
এক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে আবেদনে সম্মতি জানানো বা খারিজ করার অধিকার থাকে। কর্তৃপক্ষ পড়ুয়ার আবেদনে সিলমোহর দিলে সেটি চলে যায় রাজ্য সরকারের কেন্দ্রীয় পোর্টালে।
প্রধান শিক্ষকের স্তরে কোনো পড়ুয়ার ব্যাংক তথ্য বদলের সুযোগ থাকে না। তিনি শুধু আবেদন যাচাই করে অনুমোদনের পর সেটি পাঠিয়ে দিতে পারেন পরবর্তী স্তরে।
কেন্দ্রীয় পোর্টালে আরেক দফা যাচাই করা হয় পড়ুয়াদের তথ্যগুলি। সেই তথ্য অনুমোদন করে পাঠিয়ে দেয়া হয় ট্রেজারিতে। সেখান থেকে টাকা পাঠানো হয় ছাত্র-ছাত্রীদের অ্যাকাউন্টে।
রাজ্যের পদক্ষেপ
টাকা পাঠানোর পরও যেসব পড়ুয়ার কাছে তা পৌঁছয়নি, তাদের অ্যাকাউন্টে আবার ১০ হাজার টাকা করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিক্ষা দপ্তর। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গিয়েছে, মোট ছটি জেলার কম বেশি ৩০০ পড়ুয়ার টাকা উধাও হয়ে গিয়েছে।
সেই তুলনায় যেসব পড়ুয়ার অ্যাকাউন্টে একাধিকবার টাকা জমা পড়েছে, তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। শুধু মুর্শিদাবাদে প্রায় হাজার পাঁচেক ছাত্র-ছাত্রীর অ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকা জমা পড়েছে। প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ফিরে পেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আধিকারিকদের।
সোমবার নবান্নে এই বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হয়। সেখানে ছিলেন মুখ্য সচিব মনোজ পন্থ, শিক্ষা সচিব বিনোদ কুমার, রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার।
বৈধ পড়ুয়াদের টাকা অন্য যেসব অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে, সেগুলিকে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চলছে। সেই অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে ইতিমধ্যে। রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, এই অনিয়মের সঙ্গে কোনো সরকারি আধিকারিক যুক্ত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দুর্নীতি না হ্যাকিং
রাজনৈতিক শিবিরে ট্যাব নিয়ে যথারীতি তরজা শুরু হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ এটা রাজ্য সরকারের আর একটা দুর্নীতি। সরকারি টাকা ছাত্র-ছাত্রীদের বদলে দলের লোকেদের পাইয়ে দেয়া হয়েছে। তৃণমূল সামনে এনেছে হ্যাকিংয়ের তত্ত্ব।
বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেন, "শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ, আবাস যোজনা, রেশনের চাল চুরি, কোথায় না এই রাজ্য সরকার দুর্নীতি করেছে। এবার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য অনুদানের টাকাও তৃণমূল হাতিয়ে নিতে চায়। এর সঠিক তদন্ত করে দোষীদের ধরা উচিত।"
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, "অনেক সময় সাংসদদের বেতন একজনেরটা অন্যজনের কাছে চলে যায়। এটা কারিগরি ত্রুটি হতে পারে, কোনো ব্যক্তির ভুল বা হ্যাকিং হতে পারে। এর সঙ্গে কেলেঙ্কারির সম্পর্ক নেই। কর্তৃপক্ষের নজরে আনলে সংশ্লিষ্ট পড়ুয়ার অনুদান পেতে সমস্যা হবে না।"
সাইবার বিশেষজ্ঞ সাম্যজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, "পড়ুয়াদের তথ্য অন্যান্য যে কোন ডেটার মতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ট্রান্সফার হয়। কেন্দ্রীয় পোর্টালে যারা সেই তথ্য যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছেন, সেই স্তরে কিছু হয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে হবে। আবার পুরোটাই হ্যাকারদের কাজ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।'
বিশেষজ্ঞের বক্তব্য অনুযায়ী, স্কুল স্তরে প্রধান শিক্ষকের পক্ষে ছাত্র-ছাত্রীর দেয়া ব্যাংক তথ্য বদল করার সুযোগ নেই। সেই কারণে প্রধান শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এফআইআর নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে।
শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষক কিংকর অধিকারী বলেন, "তদন্ত ঠিকঠাক না হলে বোঝা যাবে না, এটা দুর্নীতি না হ্যাকিং। রাজ্য সরকারের দায়িত্ব এর রহস্য উদ্ধার করা। তবে প্রধান শিক্ষক কোনো প্রতিষ্ঠানের মাথায় থাকেন বলে, অভিযোগ উঠতেই তার বিরুদ্ধে এফআইআর করা ঠিক নয়। আমরাই এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছি।"