পণ্য ও পরিষেবা করের এক বছর
৪ জুলাই ২০১৮জিএসটি'র বর্ষপূর্তি উদযাপন করলো মোদী সরকার৷ নতুন এই কর ব্যবস্থার সাফল্য ও বিফলতা নিয়ে গোটা ভারতের রাজনীতি উত্তাল৷ সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে বিরোধীরা৷ বিশেষত কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ অন্যান্য দলগুলি৷ কংগ্রেস দলের পেশ করা এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশের বেশিরভাগ (৬৩ শতাংশ) মানুষ মনে করছেন, জিএসটি চালু হওয়ার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম এতটুকু কমেনি৷ বরং বেড়েছে৷ ৫৭ শতাংশ মানুষের মতে, রেস্তোরাঁয় খাবারের খরচ অনেকাংশে বেড়েছে৷ আবার, ৬১ শতাংশ মানুষের মতে, কর আদায় করা ও জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতায় আটকা পড়ছেন ব্যবসায়ীরা৷ খরচও কয়েকগুন বেড়েছে৷ এদিকে, বসে নেইশাসক দল বিজেপি৷ এই ইস্যুতে কংগ্রেসকে পালটা আক্রমণ করে চলেছে তারাও৷ বিরোধীদের আক্রমণের জবাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য, ‘‘মার্সিডিজ গাড়ি এবং দুধের ওপর একই হারে কর বসতে পারে না৷ কংগ্রেসের দাবি মেনে নিলে রাতারাতি খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে৷''
গতবছর ১ জুলাই থেকে শুরু হয় জিএসটি৷ পণ্য বিক্রি ও পরিষেবার ওপর একটাই কর৷ সরকারের দাবি ছিল, জিএসটি আনার লক্ষ্য, দেশে চালু থাকা প্রায় ২০-২৫টি (সিএসটি, ভ্যাট, সার্ভিস ট্যাক্স) কর বাতিল করে একটি মাত্র কর চালু করা৷ বর্তমানে বিশেষজ্ঞতের মত, জিএসটি-র সঙ্গে যুক্ত প্রশাসনিক কর্মীরা এখনও অপ্রশিক্ষিত৷ তাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে আপ-টু-ডেট করার পরিবর্তে জোর করে কর আদায় করতে শুরু করেছে সরকার৷ এতে ঘুরিয়ে প্রসাসনিক কর্তাদের ‘দাদাগিরি' বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এছাড়াও জিএসটিএন বা জিএসটি নেটওয়ার্কের আগাম পরীক্ষা করা হয়নি৷ তা সত্ত্বেও ভারত সরকারের পক্ষে দাবি করা হয়েছে, দেশে জিএসটি চালু হওয়ার এক বছরের মধ্যে ৭০ শতাংশ পরোক্ষ করদাতা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ১৭টি কর ও ২৩টি সেস এক জায়গায় এসে মিশেছে৷ চেকপোস্টের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে৷
পোড় খাওয়া রাজনীতিক এবং প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পালানিআপ্পান চিদাম্বরমের সরাসরি অভিযোগ, জিএসটি হলো মোদী সরকারের অপরিকল্পিত ও হঠকারী সিদ্ধান্তের ফসল, যার কুফল ভোগ করছে গোটা দেশ৷ নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের মতোই জিএসটি চালু করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি৷ ছোট-বড় ব্যবসায়ী থেকে রপ্তানিকারকম সবাই পথে বসেছেন জিএসটি'র জন্য৷ তাঁর কথায়, ‘‘জনগণ ও ব্যবসায়ীদের কাছে আতঙ্কের শব্দ পণ্য ও পরিষেবা কর৷ জিএসটি'র জন্য দেশ তৈরি ছিল না৷ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ অপরিকল্পিত ও হঠকারীভাবে চালু করা হয়েছে এই কর ব্যবস্থা৷ প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে আবার একবার ‘ইউটার্ণ' নিচ্ছেন মোদিী৷'' তামিলনাড়ু বিধানসভায় সে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রীর এক বিবৃতির উল্লেখ করে চিদাম্বরম বললেন, ‘‘২০১৭-১৮ সালে ৫০ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়েছে৷ কর্মহীন হয়েছে ৫ লাখ লোক৷ জিএসটি-তে একাধিক হার আছে৷ এর মধ্যে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত করের হার রাখা হয়েছে৷ ইচ্ছেমতো কর নির্ধারণ করায় জিএসটি-র মূল উদ্দেশ্যটিই বিকৃত হয়েছে৷''
ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে জিএসটি চালু হওয়ার পরেও মুদ্রাস্ফীতির উপর কোনো প্রভাব পড়েনি৷ ক্রেতাদের কাছে অনেক পণ্য বা পরিষেবার দাম আপেক্ষিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে৷ উদাহরণ হিসেব বলা যেতে পারে, আগে ইন্টারনেটে সিনেমার টিকিট ক্রয় করলে বুকিং চার্জের ১৪ শতাংশ সার্ভিস ট্যাক্স, ০ দশমিক ৫ শতাংশ স্বচ্ছ ভারত সেস এবং ০ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষি কল্যাণ সেস দিতে হতো৷ অর্থাৎ মোট ১৫ শতাংশ৷ এখন তাঁর জায়গায় ‘এক দেশ এক কর'-এর নামে দিতে হচ্ছে ১৮ শতাংশ জিএসটি৷ তাছাড়া পেট্রোপণ্য ও বিদ্যুৎ পরিষেবাকে জিএসটি-র আওতায় আনা হয়নি কেন? তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷ কারণ, দেশের অর্থনীতির প্রায় অর্ধেক নিয়ন্ত্রিত হয় এই পেট্রোপণ্য ও বিদ্যুতের আয়-ব্যায়ে৷ অথচ, এই দু'টি বিষয়কে জিএসটি'র আওতায় থেকে বাদ রেখে দেশজুড়ে একক কর ব্যবস্থার দামামা বাজাচ্ছে সরকার!
ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পরিষেবা নিলে জিএসটি থাকছে৷ সরকার ১৫ শতাংশ সার্ভিস ট্যাক্স থেকে এক লাফে ১৮ শতাংশ জিএসটি করার ফলে বেশি টাকা দিতে হচ্ছে৷ এই তালিকায় পড়ছে ক্রেডিট কার্ড৷ আগে ক্রেডিট কার্ড স্টেটমেন্টে যদি ১৫ শতাংশ হারে ৫০২ টাকা ট্যাক্স বাবদ আসতো, এখন আসে ৬০২ টাকা৷ কারণ, ১৮ শতাংশ জিএসটি৷ একইভাবে এটিএম ব্যবহারে খরচ বেড়েছে৷
পাঞ্জাবের অর্থমন্ত্রী জিএসটি নিয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ৷ তিনি জানালেন, ‘‘বিশ্বে ১১৫টি দেশে জিএসটি চালু আছে৷ নকল করতে হলে তাতেও দক্ষতা লাগে৷ এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সরকার অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে৷ শতকে একবারই এমন সুযোগ আসে সরকারের হাতে৷ আমাদের বলা হয়েছিল, এই কর চালু হলে কেন্দ্র, রাজ্য, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের উপকার হবে৷ করের হার অনেক কমে যাবে৷ কিন্তু, বাস্তবে হয়েছে তার উল্টোটা৷ এর কারণ, মোদী সরকার এই করের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা পর্যন্ত করেনি৷ কোনো রাজ্যই খুশি নয়৷''
জিএসটি চালু হওয়ার পর তৈরি হচ্ছে এমন বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনলে কর, সরকারি স্ট্যাম্প ডিউটি ও পঞ্জিকরণের খরচ মিলিয়ে অতিরিক্ত ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২১ দশমিক ১ শতাংশ দিতে হচ্ছে৷ জিএসটি ১২ শতাংশ, ৪ থেকে ৮ শতাংশ স্ট্যাম্প ডিউটি এবং পঞ্জিকরণের খরচ ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত৷ গত বছর ১ জুলাইয়ের আগে এজন্য দিতে হতো ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ৷ আগে পরিষেবা কর ছিল ৪ দশমিক ৫ শতাংশ৷ ভ্যাট ছিল ০ থেকে ৫ শতাংশ৷ স্ট্যাম্প ডিউটি ছিল ৪ থেকে ৮ শতাংশ৷ পঞ্জিকরণের খরচ ছিল ০ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ১ শতাংশ৷