পথের বাঁকে - ১
৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯তাই রাজধানী ঢাকা না গিয়ে রাজশাহীতেই কাটালাম জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷ শুধু লেখাপড়াই নয় স্মৃতির এক বিশাল জগৎ তার সাথেই গাঁথা৷
তাই জার্মানির সবুজ শহর বনে এসে বার বার ফিরে ফিরে দেখি রাজশাহীর দিনগুলো৷ বিশেষ করে বন শহরের প্রতিটি অলিতে-গলিতে যে নিবিড় গাছের ছায়া, সবুজের সমারোহ তার সাথে শুধু মতিহারের সবুজ চত্বরেরই তুলনা হয়৷ যদিও রাজশাহীর পথে পথে এখন আরো একটু বেশি সবুজের ছোঁয়া লাগানো হচ্ছে৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ আঙ্গিনাটুকু যত ছোট ছিল বন তো আর ততোটুকু নয়৷ তাই ১২ বছর ধরে মতিহারকে দেখেও যেমন চোখ জুড়ায়নি, সম্ভবত সারাজীবন বন শহরকে দেখলেও একই ঘটনাই ঘটবে৷ আজও তাই ঘুম থেকে জেগে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই দেখি নতুন এক সবুজ, নাম না জানা বৃক্ষলতার হাতছানি আর পাখিদের মিষ্টি সুর৷
একদিন আমার বাসায় এক বন্ধু এসে বললো, তোমার বাসার চারিদিকে গাছের বাহার খুবই চমৎকার৷ আসলে পাতাগুলোর নড়া-চড়াই বলে দেয় জীবনের অস্তিত্বের কথা৷ আমি বললাম, সত্যি এখানকার অধিকাংশ বাড়ি সেকারণেই বুঝি একতলা করে বানানো৷ যাতে করে নিজেদের সাজানো বাগানের গাছ-পালা আর জীবকুলের সাথে সার্বক্ষণিক একটা সম্পর্ক সহজেই বজায় থাকে৷ একতলা বাড়ি করার পেছনে অবশ্য আরেকটা যুক্তি আছে৷ তা হলো প্রতিবেশীদের মাঝে যতোটা সম্ভব সমতা বজায় রাখা৷ একই এলাকায় যেন প্রায় একই সমান উঁচু ঘর-বাড়ি থাকে সেটা বেশ খেয়াল রাখেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ৷
আর প্রকৃতি ও বৃক্ষ প্রেমের কথা বলে শেষ করা যাবে না হয়তো৷ তবে এই প্রেম শুধুই প্রকৃতি কিংবা গাছের প্রতি নয়৷ তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের প্রতি৷ শহরের নাগরিকদের অধিকার, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, ভালোবাসা আর ভালো থাকার সুযোগ করে দিতে গিয়েই তাদের প্রেমে পড়তে হয়েছে প্রকৃতিরও৷ কারণ মানুষগুলোকে সুখে রাখতে হলে প্রকৃতির যে বিকল্প নেই৷ সেকথাটিই এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নীতি নির্ধারকরাও৷
শহরই বা বলি কেন? বনকে যতটা না শহর বলতে ইচ্ছা করবে তার চেয়ে অনেক বেশি সঠিক হবে গ্রাম বলাটাই৷ প্রায় প্রতিটি বাড়িই রাস্তা থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে তৈরি৷ বাড়ির চারিদিকে গাছ-পালা ভর্তি মনোরম বাগান৷ কয়েকটি বাড়ির ছেলে-মেয়েদের জন্য এক টুকরো খেলার জায়গা৷ প্রায় প্রতিটি রাস্তার পাশে সাজানো বাগান৷ দীর্ঘদেহী গাছের সারি৷ আবার অল্প-স্বল্প পথ পেরোলেই দেখা মিলবে বিস্তীর্ণ ক্ষেত৷ ধান ক্ষেত, গম ক্ষেত, সব্জি ক্ষেত আবার কোথাও গরু, ঘোড়া কিংবা ছাগলের চারণভূমি৷ অথচ সেসব চাষাবাদের জমির মাঝ বরাবর চলে গেছে মসৃণ পাকা রাস্তা৷ কোথাও সর্পিল রেল লাইন৷ সেই পথ ধরে ছুটে চলছে বাস, কার, ট্রাম, ট্রাক, লরি আর বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলা ট্রেন৷ ক্ষেতের পাশেই বাথান বাড়ি৷ অবশ্য বাথান বাড়ির সামনে গরুর গাড়ি আর জোয়াল, লাঙ্গল, কোদাল, কাস্তে এসব নেই, তার বদলে আছে বিভিন্ন আকার-আকৃতির আধুনিক যন্ত্র চালিত চাষের সরঞ্জামাদি৷
নগর কর্তৃপক্ষের কাছে শুধু যে, নাগরিক এবং তাদের গাড়ি-বাড়ির তালিকা রয়েছে তা-ই নয়, রয়েছে বাগান এবং বাগানগুলোর প্রতিটি গাছের বিশদ বিবরণ৷ কোন গাছের কবে চুল ছাঁটতে হবে, কবে কোন খাবার কিংবা পানীয় দরকার কিংবা ঔষধ - তার ঠিকঠাক হিসাব রয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে৷ আর নিয়ম মাফিক প্রতিটি গাছের জন্য প্রয়োজনমতো খাবার, পানীয়, ঔষধসহ সবধরণের পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছে ঐসব দপ্তরের কর্মীরা৷ এক সহকর্মীর কাছে গল্প শুনলাম৷ বাড গোডেসবার্গে তার বাড়ির সামনে একদিন একটি গাছ কাটতে আসল সরকারি লোকজন৷ তা দেখে সে খুব আশ্চর্য হলো৷ এমন ঘটনা তো কখনো ঘটেনি৷ বাসা থেকে বের হয়ে সে লোকগুলোর কাছে গেল৷ এমনকি সে তাদের গাছ কাটতে নিষেধ করলো৷ জবাবে লোকগুলো তাদের কাছে থাকা ঠিক ঐ গাছের অভ্যন্তরীণ অবস্থার ছবি দেখালো৷ সাথে উদ্যান বিশেষজ্ঞের ব্যবস্থাপত্রও৷ এসব কাগজপত্র দেখে সে হতবাক৷ এখানে একজন মানুষের যেমন চিকিৎসার নথিপত্র সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়, ঠিক একটি গাছেরও ভেতরের ছবি, তার অবস্থা এবং করণীয়ও যথাযথ বিশেষজ্ঞের দপ্তরেই সংরক্ষিত থাকে৷
বৃক্ষ আর প্রকৃতি প্রেমের এতো কাহিনী শুনে যারা বলবেন, এসব আসলে সরকারেরই দায়িত্ব - তাদের জন্যই আছে শ্রেবেরগার্টেনের খবর৷ জার্মান ভাষায় শ্রেবেরগার্টেন এর অর্থ হলো শখের বাগান৷ একটি সূত্র অনুযায়ী, জার্মানিতে এই ধরণের বাগান মিলিয়নের ঘর ছুঁয়েছে৷ অথচ এসব বাগান তৈরির কাজে সরকারের তেমন কোন ভূমিকা নেই বললেই চলে৷ মূলত ব্যক্তিগত পরিচর্যায় গড়ে ওঠে এসব বাগান৷ ছোট্ট এক টুকরো জমি ভাড়া নিয়ে নিজের মতো করে সাজিয়ে তোলা যায় শ্রেবেরগার্টেন৷ সাধারণত রেল লাইন কিংবা রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় গড়ে তোলা হয় এসব বাগান৷ দেখা যায় বাগানের মাঝে কিংবা পাশে আছে ছোট্ট একটি ঘর৷ রয়েছে একটি বিশাল ছাতা, কিংবা একটি ঝুলন্ত দোলনা, দু'একটি চেয়ার, সাথে ছোট্ট টেবিল৷ সপ্তাহান্তে কিংবা একটু অবসরে আয়েশ করে কিছু সময় কাটানো যায় নিজ হাতে গড়া এই শখের রাজ্যে৷ নানা বাহারের ফুল, ফল আর লতা-পাতায় ঘেরা এসব শখের বাগানই বলে দেয় শুধু কর্তা ব্যক্তিরাই নন সাধারণ মানুষও কতটা প্রকৃতিপ্রেমী৷
প্রতিবেদক: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক