1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পদলোলুপ, পুনর্মুষিক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়?

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
২০ অক্টোবর ২০২২

বিসিসিআই সভাপতি না হতে পেরে সৌরভ আবার পশ্চিমবঙ্গের ক্রিকেট সংস্থার সভাপতি হওয়ার কথা বলেছেন। এতে কি তার গৌরব বাড়বে?

https://p.dw.com/p/4IRqI
বিসিসিআই থেকে বিদায়ের পর সৌরভ সিএবি সভাপতি হতে চাইছেন।
বিসিসিআই থেকে বিদায়ের পর সৌরভ সিএবি সভাপতি হতে চাইছেন। ছবি: Getty Images/AFP/P. Paranjpe

মাছকে যেমন জল থেকে তোলা হলে ছটফট করে, তেমনই কিছু মানুষ আছেন, যারা পদ চলে গেলে ঠিক তেমনই করতে থাকেন। এই ছটফটানির শেষতম উদাহরণ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বড় আদরের দাদা।

সৌরভ খেলা ছাড়ার পর প্রথমে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল(সিএবি)-ক সভাপতি হয়েছেন। তারপর সেখান থেকে একলাফে ভারতের ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআইয়ের সভাপতি হয়েছেন। আর এখন একটা বাচ্চাও জানে, ভারতে কোনো ক্রীড়াসংস্থার শীর্ষপদে বসতে গেলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থন লাগে। কারণ, অলিখিত নিয়মই হলো, যার হাতে শাসনক্ষমতা থাকবে, তার হাতে ক্রীড়াসংস্থাগুলিও থাকবে। এভাবেই সিএবিতে থাকতে গেলে তৃণমূলের সমর্থন চাই, বিসিসিআইতে থাকতে গেলে বিজেপি-র।

এই সমর্থন না থাকলে কী হয়, তার উদাহরণ হলেন বাইচুং ভুটিয়া। দেশের ফুটবল সংস্থা এআইএফএফের সভাপতির নির্বাচনে বাইচুং মাত্র একটি ভোট পেয়েছিলেন। আর পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা, যাকে তার দল সমর্থন করছিল, তিনি সভাপতি নির্বাচনে হইহই করে জিতলেন। প্লেয়ার হিসাবে বাইচুং ও কল্যাণের কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু ফুটবল প্রশাসকের পদে বাইচুং নামটা যথেষ্ট ছিল না। বিজেপি-র সমর্থনও দরকার ছিল।

ঠিক এইভাবেই অতীতে সৌরভ সিএবি ও বিসিসিআই-তে সভাপতির পদ পেয়েছেন। সিএবি-তে তৃণমূলের সমর্থনে এবং বিসিসিআই-তে বিজেপি-র। কিন্তু বিজেপি যখন নিজেদের দলের বাইরের কাউকে সমর্থন করবে, তখন তো তার কিছু শর্ত থাকে, প্রত্যাশা থাকে, দেয়া-নেয়ার অঘোষিত অঙ্ক থাকে। সভাপতির পদ পাওয়ার পর সেই অঙ্কটা নিজের সুবিধামতো ভুলে গেছিলেন সৌরভ। বিজেপি তাকে পশ্চিমবঙ্গে দলের মুখ করতে চেয়েছিল। চেয়েছিল, বিধানসভা নির্বাচনে সৌরভই দলের মুখ হোন। কিন্তু অনেক হিসাব কষে, চিন্তাভাবনার পর সৌরভ সেই পথে যাননি। তাই এবার বিজেপি নেতৃত্ব বা বলতে গেলে অমিত শাহ বিসিসিআই থেকে সৌরভের বিদায় নিশ্চিত করে দিয়েছেন। সেই বিদায়টা খুব একটা গৌরবের হয়নি। বরং বিসিসিআই বৈঠকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে অপমানিত হয়েই পদ ছাড়তে হয়েছে সৌরভকে।

তাতে বঙ্গসন্তানরা বেজায় চটেছেন। চটতেই পারেন। কারণ, আবেগ তাদের বশ করেছে। তারা একবারের জন্যও ভেবে দেখছেন না, এই সৌরভই কীভাবে তিন বছর আগে ব্রিজেশ প্যাটেলের বোর্ড সভাপতি হওয়ার পাকা ঘুঁটি শেষমুহূর্তে খেয়ে নিয়েছিলেন। সাবেক ক্রিকেটার ব্রিজেশ প্যাটেলেরও সভাপতি না হতে পারাটা তার কাছে অপমানকর ছিল। তখন কিন্তু গুজরাটের ব্রিজেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গের সৌরভকেই বেছে নিয়েছিলেন অমিত শাহরা। কারণ, তাদের কাছে সৌরভকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গে ভোটে জেতার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। তাই ব্রিজেশ প্যাটেলকে তখন সমর্থন করা শ্রীনিবাসন এখন বাগে পেয়ে সৌরভকে বোর্ডের বৈঠকে তুলাধুনো করলে আম-বাঙালি এরকম রে রে করে ওঠার কারণ কি? সৌরভও তার সুবিধামতো সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন, শ্রীনিবাসনও করলেন।

সৌরভ তো এখনো মাঝেমধ্যেই গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে তার সেই বিখ্যাত বিরোধ নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। কোনো সন্দেহ নেই, গ্রেগ চ্যাপেল সৌরভের প্রতি অন্যায় করেছিলেন। নিজের প্রভাব বজায় রাখতে গিয়ে তিনি সৌরভকে ছেঁটে ফেলেছিলেন। এই অন্যায় ও অনৈতিক কাজ কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু বিরাট কোহলি ও ঋদ্ধিমান সাহার সঙ্গে কী করলেন সৌরভ? কোহলির কাছ থেকে যেভাবে তিনি টি-টোয়েন্টি ও একদিনের ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব কেড়ে নিলেন, সেটা কি গ্রেগ চ্যাপেলের কথা মনে পড়ালো না? ঋদ্ধিমান সাহাকে যখন দ্রাবিড় ডেকে বলে দিলেন, বয়স হয়েছে, তাই তোমাকে আর দলে রাখা হবে না, তখন তো সৌরভ নীরব থেকে তাতে সায় দিলেন।

ডয়চে ভেলে
গৌতম হোড়ছবি: privat

অথচ, ঋদ্ধিমান একের পর এক ম্যাচে ভালো খেলে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছিলেন। তার উইকেট কিপিং নিয়ে সারা ক্রিকেট বিশ্ব প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। কিন্তু সৌরভ তাকে ছেঁটে ফেলার কাজে সহায়তা করলেন। পরে দীনেশ কার্তিক যখন নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে ৩৭ বছর বয়সে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেলেন, তখন দ্রাবিড়-সৌরভরা বয়সের কথা ভুলে গেলেন। ঋদ্ধিমান অনেক কষ্ট নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরায় চলে গেলেন ক্রিকেট খেলতে, তখন অন্তত প্রকাশ্যে ঋদ্ধিমানকে ডেকে বাংলা থেকে না যাওয়ার কথা বললেন না সৌরভ। এর পর গ্রেগ চ্যাপেলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আর কি মুখ খোলার মতো নৈতিক অবস্থান তাকে সৌরভের? থাকে না, কারণ, ক্ষমতা পেয়ে তিনিও গ্রেগের পথেই হেঁটেছেন।

বিজেপি-র স্বার্থসিদ্ধি হয়নি। তারপর তারাও সৌরভকে আর বিসিসিআইয়ের সভাপতি পদে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। এটা তো সৌরভ ও বিজেপি-র মধ্যের বিষয়। বোর্ডের বাকি কর্মকর্তাদের দিকে তাকান। অমিত শাহের ছেলে জয় শাহ বোর্ডের  সচিব বা সম্পাদক। যুগ্ম সচিব দেবজিৎ সইকিয়া, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ঘনিষ্ঠ। কোষাধ্যক্ষ আশিস শেলার, মহারাষ্ট্রে বিজেপি বিধায়ক। আইপিএলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান অরুণ কুমার ধুমল, তিনি হলেন বিজেপি মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের ভাই। বোর্ডের সভাপতি রজার বিনি বিজেপি-তে নেই। কিন্তু একজন সাবেক ক্রিকেটারকে সরিয়ে আরেকজন সাবেক ক্রিকেটারকে আনা হয়েছে, যিনি জয় শাহ তথা বিজেপি-র সব কথা শুনে চলবেন। এছাড়া সহ সভাপতি রাজীব শুক্লা কংগ্রেস নেতা হলেও বিজেপি-র সাবেক মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের আত্মীয়। এর থেকে স্পষ্ট, বিজেপি যাকে চাইবে, তিনিই বোর্ডে থাকবেন। সৌরভকে তারা চায়নি বলে তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। তা বিজেপি ও সৌরভের মধ্যের ঝামেলা নিয়ে এত হাহুতাশ, এত অপমান, বঞ্চনার অভিযোগ তো অর্থহীন। বিজেপি যদি সৌরভের বিরুদ্ধে কথা না রাখার অভিযোগ আনে, তখন?

বোর্ডের সভাপতির পদ হারাবার পর সৌরভ কী করলেন? তিনি জানিয়ে দিলেন, আবার সিএবি-র সভাপতি পদে লড়বেন। অর্থাৎ, পুনর্মুষিক ভব। সিএবি থেকে প্রশাসক হিসাবে সৌরভের যাত্রা শুরু, তারপর বোর্ডের সভাপতি হওয়া। সেখানে থাকতে না পেরে আবার সিএবি-তে? একবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কি কেউ মন্ত্রী হন? না কি, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মন্ত্রী? দ্বিতীয় ক্ষেত্রে উদাহরণ হলো দেবেন্দ্র ফড়নবিস ও বাবুলাল গৌড়। দুজনেই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মন্ত্রী হয়েছিলেন। ফড়নবিস এখনো মন্ত্রী। কিন্তু তাদের তখন বলে পদলোলুপ। যেরকম সৌরভকে দেখে এখন মনে হচ্ছে, তিনি পদ ছাড়া ওই জল থেকে তোলা মাছের মতো ছটফট করছেন। এই ক্ষমতালোলুপ ও পদলোলুপদের নিয়ে হাহুতাশ করার, বঞ্চনার কাহিনি শোনানোর, দুফোঁটা চোখের জল ফেলার কী কোনো প্রয়োজন আছে? ক্রিকেটার সৌরভ, ধুরন্ধর অধিনায়ক সৌরভ, লড়াকু সৌরভের জন্য যতটা গর্ব, সমর্থন, আদর ছিল, প্রশাসক সৌরভ তাতে জল ঢেলে দিলেন।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷