পরিবহণ মালিকেরা কত শক্তিশালী?
২৯ নভেম্বর ২০২১অর্ধেক ভাড়ার দাবি নিয়ে মাঠে নামার পর গত বৃহস্পতিবার পরিবহন মালিক সমিতির এক অনুষ্ঠানে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের এই দাবির প্রতি সমর্থন জানান। তিনি তার ছাত্রজীবনের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, তিনি নিজেও হাফ ভাড়া দিয়েছেন ছাত্র জীবনে। পাকিস্তান আমলেও হাফ ভাড়া ছিলো বলে জানান তিনি। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিকদের অনুরোধ করেন। ওইদিনই সন্ধ্যায় বিআরটিএ বাস মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে। যারা যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় তার দুই পাশে ছিলেন তারাই সন্ধ্যার বৈঠকে হাফ ভাড়ার ব্যাপারে ‘না' বলে দেন বিআরটিএকে। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে বাস মালিকেরা কি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী?
শুধু যোগাযোগ মন্ত্রী নয়, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানও শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার দাবি যৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন। আর আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগও অর্ধেক ভাড়ার দাবি ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তারপরও বাস মালিকেরা তা মানছেন না।
এর আগেও ডিজেলের দাম বাড়ার পর কোনো ঘোষণা ছাড়াই পরিবহণ ধর্মঘট করে পরিবহন মালিকেরা সারাদেশ অচল করে দেন। মন্ত্রীরা বা বিআরটিএ সময় চাইলেও তারা সময় দেননি। তারা ইচ্ছেমত ধর্মঘট ডেকে খুশিমত ভাড়া আদায় করে নিয়েছেন। আর এখন তার চেয়েও বেশি দেড়গুণ আদায় করছেন। কেউই তাদের এই নৈরাজ্য থামাতে পারছেন না কেন?
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন,"সরকারের প্রতিষ্ঠানই তো নিয়ম নীতি মানে না। সিটি কর্পোরেশনের গাড়িগুলো চালায় পরিচ্ছন্নকর্মী, ড্রাইভারদের লাইসেন্স নাই, গাড়ির ফিটনেস নাই। এটা দেখে তো বেসরকারি যানবাহনের মালিকেরা উৎসাহিত হন। আর বাসের মালিক কারা? সরকারের মন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তাহলে কারা তাদের থামাবে?”
তিনি মনে করেন,"এই কারণেই এখন পরিবহন শ্রমিকেরা শিক্ষার্থীদের পেটাচ্ছে, হয়রানি করছে, ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু তারা যতই বাড়ুক না কেন তাদের অর্ধেক ভাড়ার দাবি মানতেই হবে। এটা শিক্ষার্থীদের অধিকার।”
তার মতে, "মালিকেরা এমনিতেই নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নিচ্ছেন। আর ভাড়া নির্ধারণের সময় শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়টি মাথায় রেখেই নির্ধারণ করা হয়। প্রতিবাদ করলে আমরা যাত্রীরা করব। মালিকেরা কেন? আমরা তো হাফ ভাড়া সমর্থন করি।”
তিনি বলেন,"ভাড়া নির্ধারণে মালিক থাকে কিন্তু যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি থাকেনা। ফলে যা খুশি তাই করে।”
মোট সিটের শতকরা ৭০ ভাগ বিবেচনায় নিয়ে বিআরটিএ বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। এরপর প্রতিটি বাসে সামনের দিকে দুই-তিনটি অবৈধ সিট থাকে। উপরন্তু সিটের বাইরেও দাঁড়িয়ে কমপক্ষে ১৫জন যাত্রী বহন করা হয়। ফলে বাস মালিকেরা তাদের প্রকৃত যে আয় হওয়ার কথা তার দ্বিগুণ আয় করে একই খরচে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন,"এর বাইরে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বাড়তি ভাড়া ও কিলোমিটার চুরি তো আছেই। বাস মালিকেরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিলে তো লোকসান হওয়ার কোনো কারণ নেই। একটি বাসে সর্বোচ্চ তিন-চারজন শিক্ষার্থী থাকে।”
তার মতে,"বাস মালিকদের কাছে সরকার ও সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাারা টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। এই বাস মালিকেরা চাঁদার নামে যে কোটি কোটি টাকা তোলে তার একটি অংশ অসৎ রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পায়। তারও এই বাস মালিকদের পক্ষে প্রশাসনসহ সব জায়গায় এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে বাস মালিকেরা এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।”
বাস মালিকেরা দাবি করছেন, অর্ধেক ভাড়া নিলে তাদের লোকসান হবে। একারণে তারা সরকারের কাছে প্রণোদনা ও ভর্তুকি দাবি করছেন। সেটা ছাড়া তারা শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া নিতে রাজি নন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্যাহ সোমবার জানান,"তারপরও আমরা একটা নতুন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। মালিক-শ্রমিকদের সাথে আমাদের বৈঠক চলছে। আগামীকাল(মঙ্গলবার) সকালে সংবাদ সম্মেলন করে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবো।” বাস মালিকেরা শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিচ্ছেন কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন,"আমরা সোমবারই আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাবো। এখনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।”
আন্দোলনকারীদের একজন হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের ছাত্র তাসলিম ইসলাম অভি বলেন," হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামবো না। সরকার ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর তিন দিনের মধ্যেই ভাড়া বাড়িয়ে দিল। আর আমাদের সরকারের মন্ত্রী এমপিরা শুধু সমর্থন আর প্রতিশ্রুতিই দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন করছেন না। তারাও ছাত্রজীবনে হাফ ভাড়া দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের বেলায় সেটা কার্যকর করছেন না।”
তার কথা," আমরা নিরাপদ সড়কও চাই। সড়কই যদি নিরাপদ না হয় তাহলে হাফ ভাড়া দিয়ে কী হবে? আর এই হাফ ভাড়া শুধু বাসে নয়, লঞ্চ ও ট্রেনসহ সব ধরনের গণপরিবহণে থাকতে হবে। সরকারকে এনিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।”