উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না
৮ জুন ২০১২ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জানেইরোতে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলন শুরু হওয়ার ঠিক মুখেই জাতিসংঘের পরিবেশ দপ্তর বা ইউএনইপি-র পাঁচ বছরের পরিবেশ রিপোর্ট প্রকাশিত হল৷ পেল্লাই রিপোর্টের আকার৷ টেলিফোন বইয়ের মত তার আকৃতি৷ পাঁচ বছর পর পর যেহেতু ইউএনইপি-র এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়ে থাকে, অতএব তার গুরুত্বও কম নয়৷ এবার দেখা যাক, কী বলছে সেই রিপোর্ট৷
রিপোর্ট প্রথমেই একটা মন খারাপ করে দেওয়া কথা শুনিয়েছে৷ আর তাহল, পরিবেশকে ঘিরে জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন মহল থেকে যতরকমের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তার শতকরা হিসেবে তার বড়ো কম শতাংশ বাস্তবায়িত হচ্ছে৷ যেমন উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, পরিবেশকে বাঁচাতে যে ৯০ টি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এই শতাব্দীর শুরুতে, দেখা যাচ্ছে, তার মাত্র চারটিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, বাকি ৮৬ টির ক্ষেত্রে কাজ বলতে গেলে কিছুই এগোয় নি!
বিস্মিত হওয়ার মত ঘটনা তো বটেই এটা৷ গোটা বিশ্বের সামনে আল কায়েদা বা অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সন্ত্রাসবাদী সমস্যা, সিরিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের চেয়েও যেটা এই মুহূর্তে সবথেকে আতঙ্কজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তাহল পরিবেশের ক্ষতি৷ যে গ্রহে বসবাস, জীবনযাপন এবং অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ, সেই গ্রহের পরিবেশ পরিস্থিতি এই মুহূর্তে সবচেয়ে সংকটের সম্মুখীন৷ আর দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, সে বিষয়ে হেলদোল নেই কারওই৷
হেলদোল যে নেই তার প্রমাণটাই দেখা যাচ্ছে পরিবেশের পরিস্থিতিতে৷ প্রথমে জনসংখ্যার সমস্যাটার দিকে চোখ রাখা যাক৷ দেখা যাচ্ছে, সেদিকে পরিমিতি আনতে কোনরকমের দৃষ্টি দিচ্ছে না বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশগুলি৷ জাতিসংঘের দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৫০ সালের তুলনায় জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে এই বিশ্বে৷ এই হারে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯.৩ বিলিয়নে৷ আর ২১০০ খ্রীস্টাব্দে সেই সংখ্যাটা হয়ে যাবে ১০ বিলিয়নেরও বেশি৷ আর সেই পরিমাণে মানুষের জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা অসম্ভব৷
এতো গেল জনসংখ্যার বিষয়৷ এর বাইরে যা রয়ে গেল তা'হল পরিবেশের থেকে গ্রহণ করার মানসিকতা৷ জাতিসংঘের রিপোর্টে তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, পরিবেশ থেকে জ্বালানি, খাদ্য, বিলাস ব্যসনের উপকরণ এবং আর যা যা কিছু নেওয়া সম্ভব, অর্থের বিনিময়ে তা চুটিয়ে নিয়ে নিতে কোথাও কোন দ্বিধা করছে না বিশ্বের সবকটি দেশ৷ বিশেষ করে ধনী দেশগুলির মানসিকতা এক্ষেত্রে যাকে বলে একেবারেই আপোশহীন৷
সুতরাং জাতিসংঘের রিপোর্ট একটুও বাড়িয়ে বলছে একথা তো বলা যাবে না৷ কারণ, বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্ভারের এবং প্রকৃতির দেওয়ার ক্ষমতার কোথাও নিশ্চয়ই একটা সীমারেখা রয়েছে৷ সেই সীমারেখাটাকে পার করে দিয়ে যদি ভোগবাদ বেড়ে যেতে থাকে, তার ফল কখনোই সুফল হতে পারে না৷ এবং কে না জানে, তার ফলে শুধু যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মুখ থুবড়ে পড়বে তাই তো নয়, আগামী প্রজন্ম বিশালভাবে বঞ্চিত হবে যে তাতে কোথাও কোন সন্দেহ থাকছে না৷ কারণ, তাদের খাবার, তাদের বিশুদ্ধ অক্সিজেন কিংবা তাদের পানীয় জল আমরা আজই খেয়ে, নিঃশ্বাস নিয়ে আর পান করে শেষ করে দিয়ে যাচ্ছি৷ তাদের জন্য অতএব সংকট ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট রাখছি না কেউই৷
প্রকৃতির প্রতি সদাচরণের কথা যে আজকে থেকে বলা শুরু হয়েছে তাও তো নয়৷ বেশ কয়েক বছর ধরেই এই বিশ্ব জানে সামনে কোন দুর্যোগ আসতে চলেছে আমাদের জন্য৷ সেদিকে তাকিয়ে বিভিন্ন ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেগুলির মধ্যে কতগুলো কার্যকরী হয়েছে? সে প্রশ্ন তুললে তার উত্তরে জাতিসংঘের এই পঞ্চবার্ষিকী বৈশ্বিক রিপোর্টের জবাব, রিপোর্টের খাতিরে আর পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে তারা বেছে নিয়েছিল ৯০ টি পরিবেশ বান্ধব আন্তর্জাতিক প্রকল্প৷ যেগুলো গৃহীত হয়েছে ২০০০ সালের পরে৷ আর দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে মাত্র চারটিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে৷ বাকিগুলোর মধ্যে মোট ৪০ টি প্রকল্পে সামান্য কিছু কাজ হয়েছে৷ আর বাকি সবকটাতে তেমন কোন অগ্রগতির নামগন্ধও নেই৷
যেসব প্রকল্প পিছিয়ে রয়েছে, তার মধ্যেই রয়ে গেছে সবচেয়ে দরকারি কাজগুলো৷ যেমন পরিবেশের সুরক্ষার প্রয়োজনে বৃক্ষরোপণ কিংবা বিশ্বের সকলের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা৷
এই পরিস্থিতিতেই রিও সম্মেলন শুরু হতে চলেছে৷ পরিবেশের সুরক্ষার দিকে এখনও না তাকালে আর কবে হবে সে কাজ? সে প্রশ্ন কী এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উঠবে?
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় (এএফপি/ রয়টার্স)
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন