পর্দা নামল অমর একুশে বইমেলার
পর্দা নামল অমর একুশে বইমেলার
‘আমি আর কোথাও এমন মেলা দেখিনি’
ইংল্যান্ড থেকে ৩ মাস আগে বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছিলেন মিস ক্লেয়ার৷ শেষ দিনে বইমেলায় আসার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি আর কোথাও এমন মেলা দেখিনি৷ দলে দলে বইপ্রেমী মানুষ প্রিয়জনদের নিয়ে বই কিনতে এসেছেন, ব্যাপারটা খুবই আনন্দের৷ এর ফলে পাঠক ও প্রকাশক উভয়েই লাভবান হবে বলে আমি মনে করি৷ প্রকাশনা ও শিল্পের বিকাশের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷’’
বইয়ের দাম কিছুটা বেশি?
বন্ধুর সঙ্গে মেলায় এসেছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী হৈমন্তী সরকার৷ তার মত, মেলায় বেশ কিছু বই ভালো লাগলেও দামের জন্য অনেকগুলো কিনতে পারেননি৷ করোনার কারণে সবারই আর্থিক অবস্থা খারাপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘প্রকাশনা সংস্থাগুলোর উচিত ছিল এ পরিস্থিতি বিবেচনা করে বইয়ের দাম আরেকটু কম রাখা, কারণ অধিকাংশ পাঠকই শিক্ষার্থী৷’’
সবার হাতে বই
মেলায় দর্শনার্থীদের প্রায় সবার হাতেই বই দেখা গেছে৷ মিরপুর থেকে সস্ত্রীক মেলায় ঘুরতে আসা সিফাত আহমেদ জানালেন, ব্যস্ততার কারণে এতদিন আসা হয়নি৷ ছুটির দিন এবং শেষ দিন বলে পরিবারসহ বৃহস্পতিবার এসেছেন তিনি৷ গতবছর করোনার কারণে অনেকেই আসেননি, এবার তারা এসে বই কিনছেন৷ সিফাত নিজে আটটি বই কিনেছেন বলে জানান ডয়চে ভেলেকে৷
বই বিক্রি কেমন হলো?
গত বছরের তুলনায় এবারের বইমেলায় সাড়ে ১৭ গুণ বেশি বই বিক্রি হয়েছে বলে জানান মেলার সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক জালাল উদ্দিন আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘গত বছর আমরা তিন কোটি টাকার বই বিক্রি করলেও এবারে সে অংকটি দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৫২ কোটি টাকায়৷ এবারের বইমেলায় মোট বই প্রকাশিত হয়েছে ৩,৪১৬টি, যার মধ্যে মানসম্পন্ন নির্বাচিত করা হয়েছে ৯০৯টি বই৷ এবার বাংলা একাডেমিতে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে৷’’
বইমেলায় শিক্ষাসফর
ঢাকার উত্তরার আনোয়ারা মান্নাফ গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ৩৩ জন শিক্ষার্থীর একটি দল এসেছিল বইমেলায়৷ প্রতিষ্ঠানটির বাংলা বিভাগের শিক্ষক কাওসার আহমেদ বলছিলেন, ‘‘ছুটির দিন এবং বইমেলার শেষদিন হওয়ায় আমরা শিক্ষার্থীদের এখানে নিয়ে এসেছি, এটি শিক্ষাসফরের মতোই৷ বইমেলা আমাদের প্রাণের জায়গা৷ প্রতি বছরের মতো এবারও এখানে এসে আমাদের শিক্ষার্থীরা খুব খুশি৷’’
মুখর শিশুকর্নার
বইমেলায় শিশুকর্নার অন্যরকম আকর্ষণের জায়গা৷ এখানে শিশুদের জন্য বইয়ের সম্ভার নিয়ে হাজির হয় প্রকাশনা সংস্থাগুলো৷ তবে স্টলগুলোতে বইয়ের মান ও আকারের তুলনায় দাম একটু বেশি, এমন বক্তব্য অনেক অভিভাবকেরই৷
নির্বিঘ্নে বইমেলা শেষ
অন্যপ্রকাশ প্রকাশনী সংস্থার পরিচালক সিরাজুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘‘পাঠক সারাবছর বইমেলার জন্য অপেক্ষা করে৷ করোনার তেমন কোনো প্রভাব এবারের মেলায় পড়েনি৷ সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে এবারের মেলা সফল হয়েছে, আমরা খুশি৷’’
সন্ধ্যার পরেও উপচে পড়া ভিড়
সরকারি ছুটির দিন এবং বইমেলার শেষ দিন হওয়ায় সন্ধ্যার পরেও বইমেলায় উপচে পড়া ভিড় ছিল৷ রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বইমেলা চলার কারণে সন্ধ্যার পরেও পাঠকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে৷ অনেকে জানান, যানজটের কারণে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়৷ তবে শেষ পর্যন্ত বইমেলায় আসতে পেরে এবং বই কিনতে পেরে তারা খুশি৷
বিক্রির শীর্ষে হুমায়ুন আহমেদের বই
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের প্রয়াণের ১০ বছর হয়ে গেলেও তাঁর লেখা বই এখনো বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় রয়েছে বলে জানায় অবসর, অন্যপ্রকাশসহ বেশি কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা৷ লীলাবতী, বাদশাহ নামদার, তেঁতুল বলে জোছনা, বৃষ্টিবিলাস, জোছনা ও জননীর গল্প এই বইগুলো প্রচুর বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক প্রকাশনা সংস্থা৷
শেষদিন হিসেবে ভিড় কম
চলতি বছরের বইমেলায় শুরু থেকে পাঠকদের যে পরিমাণ সাড়া ছিল, সে তুলনায় শেষদিনের ভিড় ছিল তুলনামূলক কম৷ নালন্দা, অন্যপ্রকাশ, পাঞ্জেরি, পাঠক সমাবেশ, তাম্রলিপিসহ একাধিক প্রকাশনা সংস্থার স্টলের বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানা ৩ দিনের ছুটি থাকায় অনেকেই ঢাকা ছেড়েছেন৷ ফলে ইচ্ছা সত্ত্বেও অনেকে বইমেলায় আসতে পারেননি৷
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী
বাংলা একাডেমি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রকাশকদের যৌথ উদ্যোগে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বইমেলার শেষদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১০২টি কেক কেটে উদযাপন করা হয়৷ কেক কাটার পর সেখানে লেজার শো-র আয়োজনও করা হয়েছিল৷ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ৷
সমাপ্তি অনুষ্ঠান
সমাপ্তি অনুষ্ঠানে মেলার সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘এবারের বইমেলায় মানসম্মত বই মোট প্রকাশিত বইয়ের প্রায় ২৬ শতাংশ৷ ছোট-খাটো ভুলত্রুটি থাকলেও কোনোরকম অঘটন ছাড়াই এবারের মেলা শেষ হয়েছে, এটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয়৷’’ অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, বাংলা একাডেমির সভাপতি এবং মহাপরিচালক৷
আগামীর প্রত্যাশা
করোনার অনিশ্চয়তার মধ্যে বইমেলা শুরু হয়েছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি৷ করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় ইতিহাসে দীর্ঘতম বইমেলা অনুষ্ঠিত হলো চলতি বছরে৷ ২০২১ সালের তুলনায় চলতি বছরে বিক্রি হওয়া বই প্রায় সাড়ে ১৭গুণ বেশি৷ প্রকাশক এবং লেখকরা জানান, এবারের বইমেলা যথেষ্ট সফল এবং ভবিষ্যতে যদি করোনার প্রকোপ না থাকে, তবে তারা সামনের বছর আরো ভালো ব্যবসা করতে পারবেন বলে আশা করছেন৷