পশ্চিম সাহারা নিয়ে জার্মানি-মরক্কো বিরোধ
৭ মার্চ ২০২১গত সোমবার মরক্কোর প্রধানমন্ত্রীকে লেখা সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি চিঠি ফাঁস হয়েছে। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রস্তাব, জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক বন্ধ রাখুক মরক্কো সরকারের সব অফিস। শুধু রাজধানী রাবাত নয়, অন্য যে দুইটি জার্মান কনসুলেট আছে, তাদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেয়া হোক। মন্ত্রীর মতে, এই ধরনের ব্যবস্থা জরুরি। কারণ, দুই দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি অনেক গভীরে চলে গেছে। বিশেষ করে মরক্কোর কাছে অত্যন্ত জরুরি বিষয়গুলি নিয়ে এই ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, তার মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই রাবাতে জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে সব সম্পর্ক সাসপেন্ড করেছে।
সরকারিভাবে জার্মানি এর কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। সূত্র জানাচ্ছে, জার্মান সরকার মরক্কোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। মরক্কোর রাষ্ট্রদূতকে তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠিয়ে ওই ফাঁস হওয়া চিঠির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
ইচ্ছাকৃত লিক
রাবাতে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মরত এক সূত্র জানাচ্ছে, ওই চিঠি ইচ্ছে করেই ফাঁস করা হয়েছে। চিঠিটি প্রথমে সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস করা হয়। স্থানীয় মিডিয়ার কাছেও চিঠির প্রতিলিপি পৌঁছে যায়। এমন একটা স্পর্শকাতর চিঠি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, আর সরকারের শীর্ষ নেতারা জানবেন না, সেটা হয় না। সূত্রের মতে, এই চিঠি হলো জার্মানির বিরুদ্ধে মরক্কোর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
জার্মান রাজনীতিবিদ এবং জাতিসংঘ সংক্রান্ত পার্লামেন্টের সাব কমিটির প্রধান উলরিচের মতে, মরক্কোর ধারণা হয়েছে, জার্মানি পশ্চিম সাহারায় তাদের সার্বভৌমত্বের দাবি মানতে রাজি নয়।
দীর্ঘ বিরোধ
পশ্চিম সাহারা নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। ১৯৭৫ সালে স্পেনের সাবেক কলোনি দখল করে নেয় মরক্কো। তারপর থেকে বিরোধ চলছে। এটা এলাকা দখল নিয়ে চলা বিশ্বের দীর্ঘ বিরোধগুলির মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতাপন্থিরা এখানে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছে। কিছু এলাকা তাদের অধিকারে আছে, কিছু মরক্কোর। জাতিসংঘের উদ্যোগে এখানে যুদ্ধবিরতি হয়েছে।
পশ্চিম সাহারার উপর মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হলো সেদেশের বিদেশনীতির পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকার সময় গত ডিসেম্বরে পশ্চিম সাহারার উপর মরক্কোর অধিকারকে স্বীকৃতি দেন। ইসরায়েলের সঙ্গে মরক্কো সম্পর্ক শুরু করার উপহার হিসাবে ট্রাম্প এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা কম হয়নি।
জার্মান সরকারও ইসরায়েলের সঙ্গে মরক্কোর সম্পর্ক শুরুর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু তখন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, পশ্চিম সাহারা নিয়ে তাদের মনোভাবের পরিবর্তন হচ্ছে না। তারা সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান চায়।
গত ডিসেম্বরে জার্মানি জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ জানায়, পশ্চিম সাহারার পরিস্থিতি নিয়ে যেন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করা হয়। এই বৈঠক মরক্কোর পক্ষে হতো না। তারা চাইছিল, ট্রাম্পের মতো জার্মানিও পশ্চিম সাহারায় তাদের দাবি মেনে নিক।
বিতর্কিত পতাকা
বিরোধের আরেকটি কারণ হলো বিতর্কিত পতাকা। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জার্মানির ব্রেমেন রাজ্যে পশ্চিম সাহারার স্বাধীনতা আন্দোলনের পতাকা তোলা হয়।
সরকারি ফেসবুক পেজে কয়েকজন রাজনীতিক বলেন, ওই প্রজাতন্ত্রের ৪৫ বছর পূর্তিতে পতাকা তোলা হয়েছিল।
তাছাড়া লিবিয়ার বিরোধ নিয়ে ২০২০-তে বার্লিনে বৈঠক হয়। সেখানে মরক্কোকে ডাকা হয়নি। তার জন্য সেদেশের প্রচুর ক্ষোভ আছে।
চরবৃত্তির অভিযোগ
মরক্কোর মিডিয়ার অভিযোগ, মরোক্কান-জার্মান অধিকারকর্মী হাজিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি জার্মানি। তিনি সাত বছর মরক্কোর জেলে ছিলেন। তারপর ২০১৭ সালে ছাড়া পান। তারপর তিনি জার্মানিতে ফেরেন। সেখান থেকে মরক্কো সরকার ও সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করছেন সামাজিক মাধ্যমে। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তা বাতিল করে দেয় ইন্টারপোল।
এছাড়া মরক্কোর মিডিয়া জার্মান গবেষকদের বিরুদ্ধে চরবৃত্তির অভিযোগ এনেছে। তবে সেই অভিযোগ অস্পষ্ট। তার উপর ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের একটি রিপোর্টে মরক্কো খুবই ক্ষুব্ধ। এই সংগঠনের সদর দফতর বার্লিনে।
বিরোধ মিটবে কবে
সামাজিক মাধ্যমে মরক্কোর মানুষ যে মতপ্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, বিরোধ তাড়াতাড়ি মিটবে বলে তারা মনে করছেন না। তাদের মতে, মরক্কো সম্পর্কে জার্মানি তথা ইউরোপের মত বদল করতে হবে।
তবে এই বিরোধ সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত। ২০২০-তে জার্মানির কাছ থেকে মরক্কো ১৩০ কোটি ইউরো সাহায্য পেয়েছে।
ক্যাথরিন শায়র/জিএইচ