পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্রেস জোট?
৬ মে ২০১৬বেনজিরভাবে সাত দফায় বিধানসভা ভোট হলো পশ্চিমবঙ্গে৷ যে ভোট প্রক্রিয়ার সঙ্গী ছিল প্রবল নিরাপত্তার কড়াকড়ি৷ আর ছিল মানুষের ব্যাপক উৎসাহ৷ প্রায় সব জায়গায় ৮০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে৷ তাই দেখে অনেকেই হয়ত ভাবছেন, এটা চিরাচরিত নিয়মে স্থিতি-বিরোধী ভোট৷ তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে এবার সরকার গড়বে বাম-কংগ্রেস জোট৷ কিন্তু সত্যিই কি তাই?
এঁরা সবাই ফেসবুক-টুইটারের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোয় খুব সক্রিয়৷ এঁদের কেউ ঘোষিতভাবে বাম-বিরোধী, কেউ খোলাখুলি তৃণমূল কংগ্রেসের সমালোচনায় মুখর, কেউ গোপনে বিজেপি-র সমর্থক, আবার কেউ চেষ্টা করেন নিরপেক্ষ মতামত ধরে রাখতে৷ কী হতে পারে এবারের বিধানসভা ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল – এই প্রশ্নটা রাখা হয়েছিল এঁদের প্রত্যেকের কাছে৷ ওঁরা কে কী বললেন, তা শোনার আগে একবার চট করে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক রাজ্যের বর্তমান হাল-হকিকতের দিকে৷
তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের গত পাঁচ বছরের শাসনে নজরে পড়ার মতো সাফল্য বিশেষ কিছু নেই৷ হ্যাঁ, রাস্তাঘাট আগের থেকে অনেক পরিস্কার, অনেক ভালো৷ নতুন রঙের প্রলেপ, পথের ধারে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আলো, বছরভর নানা ধরনের উৎসব – এসবও রাজ্যের একটা সুখী, স্বচ্ছল চেহারা তুলে ধরছে বটে৷ কিন্তু নতুন শিল্প আসেনি এই পাঁচ বছরে৷ নতুন কর্মসংস্থান হয়নি৷ এ ব্যাপারে সরকারের যা দাবি, তার সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতি, পরিসংখ্যান মিলছে না৷ আর দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাও ধাক্কা খেয়েছে প্রথমে সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, তার পর ভোটের ঠিক আগে নারদা টিভি-র স্টিং অপারেশনে রাজ্যের মন্ত্রী, সাংসদদের সরাসরি ঘুস নেওয়ার ছবিতে৷
তা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসই আগের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই ক্ষমতায় ফিরবে বলে মনে করছেন সাংবাদিক-চলচ্চিত্রকার অনিকেত চট্টোপাধ্যায়৷ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট আর জাতীয় কংগ্রেসের যে জোট হয়েছে, তার মধ্যে যে মৌলিক নীতিহীনতা আছে, অনিকেত ঘোষিতভাবেই তার সমালোচক৷ তাঁর ধারণা, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেও এই ভোটে সুবিধে করতে না পারার ফলে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে৷ এর জেরে ভবিষ্যতে বামফ্রন্টে ভাঙনও অবশ্যম্ভাবী৷ আরও একটু দূর এগিয়ে দেখতে চাইছেন অনিকেত যে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে এই রাজ্যে বিজেপি-কে রুখতে জাতীয় কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে জোট হতে পারে৷ সেক্ষেত্রে অভূতপূর্ব এক রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়বে বামফ্রন্ট৷
তিন বছর পর সত্যিই বিজেপিকে ঠেকাতে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং জাতীয় কংগ্রেসের জোট গড়ার বাধ্যতা তৈরি হবে কিনা, সেটা অনেকটাই নির্ভর করবে এবার বিধানসভা ভোটে বিজেপি কটা আসন পায়, তার ওপর৷ কিন্তু সেই সম্ভাবনাটা এখনও অস্পষ্ট, মনে করছেন সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট পল্লবী ব্যানার্জি৷ নিজে বামপন্থি মনোভাবের এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কট্টর সমালোচক হয়েও পল্লবী মনে করছেন, তৃণমূল কংগ্রেসই ক্ষমতায় ফিরবে, অন্তত ১৬০-১৭০ আসন নিয়ে৷ কারণ গ্রাম-মফস্বল গত পাঁচ বছরে বেশ কিছু ভালো কাজ হয়েছে, যা তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ধরে রেখেছে৷ শহরের নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যেও মমতা ব্যানার্জির এক ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে৷ তাছাড়া, আগের ৩৪ বছরের অপশাসনের জন্য বামফ্রন্টের ওপর থেকে মানুষের রাগ এখনও যায়নি৷
কাজেই পল্লবী মনে করছেন, বিরোধী জোট খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না৷ বড় জোর ১২০ থেকে ১৪০ আসন তারা পেতে পারে৷ তেমনটা হলে অবশ্য মমতার নতুন সরকারের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক হবে না৷ কিন্তু পল্লবী বেশি অস্বস্তিতে আছেন, বিজেপি এই হিসেবের মধ্যে কতটা গন্ডগোল পাকাতে পারে, সেই অনিশ্চিত সম্ভাবনা নিয়ে৷ এবং পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব যে বাড়ছে, সেটা কেউই অস্বীকার করতে পারছেন না৷ বিজেপি সমর্থক এবং ভোটার ভিক্টর বাগ যেমন জোর গলায় বলছেন, অন্তত ১০টি আসন এবার বিজেপি পাচ্ছেই৷ ভিক্টর হুগলি জেলার নালিকুলের বাসিন্দা, যেখানে নিশ্চিত একটা রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হয়েছে, যেটা ওরা বুঝতে পারছেন৷
তৃণমূল কংগ্রেস খুব সহজে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে, এমনটা মনে করছেন না বর্ষীয়ান সাংবাদিক, চলচ্চিত্র সমালোচক অনিরুদ্ধ ধর৷ কারণ তাঁর মনে হয়, এবারের ভোটে দু-তিন শতাংশের ভোটের এদিক ওদিক ফলাফল যে কোনো দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে৷ তবে একটা ব্যাপারে অনিরুদ্ধ নিশ্চিত যে ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হবে না৷ জনাদেশ খুব স্পষ্ট বিভাজিত হবে যে কোনো দিকে৷ সেটা কোন দিকে, ১৯ মে ভোটের ফল ঘোষণার আগে পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না৷ তবে সম্ভাবনা প্রবল, তৃণমূল কংগ্রেসই ১৭০ আসনের কাছাকাছি দখল করে সরকার গড়বে৷
তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার লালি বসুও মনে করেন তৃণমূল কংগ্রেসই আবার ক্ষমতায় ফিরবে, এবং সেটা এই কারণে যে প্রশাসনিক ক্ষমতা, লোকবল, অর্থবল, সবই ওদের আছে৷ যে জায়গায় লড়াইটা আগে থেকেই হেরে বসে থাকছে বিরোধীরা৷ সব জায়গায় এজেন্ট পর্যন্ত দিতে না পারাটা সেই সাংগঠনিক দুর্বলতারই লক্ষণ৷ কিন্তু লালি একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে ক্ষমতায় যেই আসুক, এই রাজ্যের পরিস্থিতির কিছুমাত্র উন্নতি হবে না৷ এই একটা ব্যাপারে দেখা গেল বিরুদ্ধমতের লোকেরা সবাই একমত৷ প্রত্যেকেই একবাক্যে বলছেন, কিছু হবে না, কিছু হতে পারে না৷ পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন সম্ভাবনা এখন এতটাই নৈরাশ্যজনক৷
আপনার কি মনে হয়? মমতা কি তাঁর মসনদ ধরে রাখতে পারবেন? লিখুন নীচের ঘরে৷