পশ্চিমবঙ্গের এক জেলায় ১২২ কৃষিজীবীর আত্মহত্যার কারণ সন্ধান
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-রাজনৈতিক ইতিহাসে ভূমি সংস্কারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। বামফ্রন্ট শাসনের গোড়ার দিকে ভূস্বামীদের জমি কেড়ে ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। এর ফলে জমিতে ভাগচাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। এতে বেড়েছিল কৃষির ফলন। কিন্তু বাম আমলেই কৃষিজীবীদের জীবনে সংকট তৈরি হতে থাকে। সেই সংকট যে দিনে দিনে আরো অনেক বেড়েছে তার প্রমাণ কৃষিজীবীদের আত্মহত্যা।
তথ্যের অধিকার আইন (আরটিআই)-এ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কৃষক মৃত্যু সম্পর্কে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। নিয়মানুসারে এই তথ্য জানতে চান আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী। জেলা পুলিশের ডিএসপি (ডি অ্যান্ড টি) ও স্টেট পাবলিক ইনফর্মেশন অফিসারের পক্ষ থেকে এই সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য চমকে দেওয়ার মতো। পুলিশ-প্রশাসনের দেওয়া তথ্য, ২০২১ সালে জেলায় ১২২ জন কৃষক ও চাষবাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পেশাজীবী আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ, শুধু চাষি নন, কৃষিকাজের সঙ্গে যাদের জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে, তাদেরও এই তালিকায় রাখা হয়েছে। চলতি বছরে এখনো পর্যন্ত ৩৪ জন কৃষিজীবী আত্মঘাতী হয়েছেন।
জেলার কোথায় কতজন
আরটিআই-এর জবাব দিতে গিয়ে জেলার ২৩টি থানা এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ঘাটাল থানা এলাকায় সর্বাধিক ৬৩ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। গোয়ালতোড়ে ১৪, আনন্দপুরে ১০, পিংলা ও কেশপুরে আট, মোহনপুর ও দাঁতনে সাত, কেশিয়ারিতে পাঁচ জন আত্মহত্যা করেছে। মোট ১২২ জন কৃষক স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করেছেন। চলতি বছরের পরিসংখ্যানে একই থানা এলাকায় এমন মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ঘাটালে সর্বাধিক ১৩ জন, দাঁতনে সাত, গোয়ালতোড় ও কেশপুরে পাঁচ, আনন্দপুর ও পিংলায় দুই কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন।
ব্যুরো-র খাতায় ‘শূন্য’
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্যের সঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুর পুলিশের দেওয়া তথ্য মিলছে না। রাজ্য সরকার এনসিআরবি-কে তথ্য দেয়। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত বছর পশ্চিমবঙ্গে কোনো কৃষকই আত্মহত্যা করেননি। অথচ আরটিআই-এর জবাবে ১২২ জনের আত্মহত্যার তথ্য মিলেছে শুধু একটি জেলায়। কৃষকদের ফসলের দাম না পাওয়া, অভাবী বিক্রি, ঋণের দায় বেড়ে যাওয়ার ফলে আর্থিক সংকট নতুন কিছু নয়। তবে এক বছরে এত বেশি আত্মহত্যার তথ্য আগে কখনো জানা যায়নি৷ অথচ ব্যুরোর খাতায় একজনের আত্মঘাতী হওয়ার তথ্যও নেই। বিরোধীদের প্রশ্ন, তা হলে কি রাজ্য কৃষক আত্মহত্যার তথ্য গোপন করছে?
এক্ষেত্রে আত্মঘাতীর পরিবারকে সরকারি সাহায্য দেওয়ার কথা। এক্ষেত্রে শাসক দল তৃণমূলের বক্তব্য, কৃষিজীবীর আত্মহত্যা কৃ্ষি সংক্রান্ত কারণে না-ও হতে পারে। তারা মনে করেন, শুধু ‘কৃষিজীবী আত্মঘাতী’ বললে সঠিক ছবি উঠে আসে না।
সংকটে কৃষি অর্থনীতি
পশ্চিমবঙ্গে কৃষিজীবীদের আত্মহত্যা প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কৃষকরা সবসময় অনিশ্চয়তায় ভোগেন। তারা বিনিয়োগ করেন, কিন্তু কতটা ফেরত পাবেন তা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। আবহাওয়া অনুকূল না হলে ফসলের ক্ষতি। আবার অনুকূল হলে অতিফলনে কৃষিপণ্যের দাম কমে যায়। অর্থাৎ, একটা সূক্ষ্ম ভারসাম্যের উপর থাকে কৃষকের ভবিষ্যৎ। গোটা ভারতে একই ছবি।” এই সংকটে কর্পোরেট পুঁজির হাত দেখছেন ফোরাম ফর ইনডিজেনাস এগ্রিকালচারাল মুভমেন্ট-এর সাধারণ সম্পাদক চিন্ময় দাস। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘উৎপাদন ব্যবস্থা ও বাজার কর্পোরেটের ইচ্ছেয় চলে। কৃষক বীজ, সারের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর নন। উৎপাদিত ফসলের বাজার না পেলে ঋণের বোঝা বাড়ে, আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়’’
ভূমি সংস্কার দিয়েছে শুধু মালিকানা
বাম আমলের ভূমি সংস্কার প্রশংসিত হলেও তার দীর্ঘমেয়াদি সুফল কি মিলেছে?
অভিরূপ বলেন,‘‘ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে জমির বণ্টন হলো, কিন্তু সেচ ব্যবস্থা ততটা সম্প্রসারিত হলো কই? কৃষক সেই আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার উপর নির্ভরশীল রইলেন। আর অতিফলনের সমস্যা যেটা বললাম, তার সঙ্গে ভূমি সংস্কারের সম্পর্ক নেই’’ চিন্ময়ের বক্তব্য,‘‘জমি হাতে থাকলেও কৃষকের বাজারের উপর নির্ভরশীলতা কাটাতে না পারলে পরিস্থিতি বদলাবে না। সেজন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে’’