ডেঙ্গু রোখার পরিকাঠামোর অভাব
১৫ নভেম্বর ২০১৭প্রশ্ন রয়েছে গ্রামীণ অঞ্চলে প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের পরিকাঠামো নিয়েও৷ এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার অভিযোগ তুলেছে, ডেঙ্গুতে নাজেহাল হলেও এ ব্যাপারে তাদের তথ্য দিচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গ সরকার৷ তাপমাত্রা কমলে মশার উৎপাত কমবে, ডেঙ্গু হানার সামনে তাই পশ্চিমবঙ্গ এখন শীতের পথ চেয়ে৷
স্মরণাতীতকালে ডেঙ্গু কখনও এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি পশ্চিমবঙ্গে৷ ২৪ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বরের মধ্যে রাজ্যে ১০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ যদিও রাজ্য সরকার ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা অনেকটাই কম করে দেখাতে চাইছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠকে ১৯ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিলেন৷ তার পাঁচ মাস পর ১০ নভেম্বর কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্য সরকারের পেশ করা হলফনামায় ওই একই সংখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে৷
এতে প্রশ্ন উঠেছে, এই ৩৫ দিনে কি মৃতের সংখ্যা বাড়েনি? অথচ রোজই কলকাতা ও জেলা থেকে মৃত্যুর খবর আসছে৷
এই বিতর্কের আড়ালে থেকে যাচ্ছে একটা বড় সমস্যা, যা নিয়ে বিশেষ আলোচনা হচ্ছে না৷ কলকাতা বা বড় জেলা শহরে ডেঙ্গু নির্ণয়ের পরিকাঠামো পর্যাপ্ত হলেও গ্রামীণ এলাকায় কী অবস্থা, সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছেন না৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের ভরসা পুরসভার ল্যাব বা বেসরকারি ছোট ল্যাব৷ জ্বর হলে যদি চিহ্নিত করা না যায় যে, এর পিছনে ডেঙ্গু না ম্যালেরিয়া না টাইফয়েড, তা হলে চিকিৎসা হবে কী করে?
এই প্রশ্নের জবাব মিলছে না৷ পুরসভার অবশ্য দাবি, তাদের পরিকাঠামো খুব উন্নতমানের৷ দমদম পুরসভার উপ-প্রধান বরুণ নট্ট বলেন, ‘‘আমাদের ল্যাব খুবই উন্নত৷ এখানে আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়৷ তাই জ্বরের কারণ ডেঙ্গু কিনা, সেটা চিহ্নিত করতে আমাদের সমস্যা হচ্ছে না৷'' রাজ্য প্রশাসনের সন্দেহ, বেসরকারি পরীক্ষণাগার ভুল রিপোর্ট দিয়ে ডেঙ্গুর আতঙ্ক ছড়াচ্ছে৷ মুখ্যমন্ত্রীও এ ধরনের অভিযোগ করেছেন৷ কিন্তু কলকাতার বেসরকারি ল্যাবের পাল্টা বক্তব্য, পুরসভা যে কোনো উপায়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কম করে দেখাতে চায়৷ তাই যেসব পরীক্ষণাগারের রিপোর্টে বেশি ডেঙ্গুর উল্লেখ থাকছে, তাদের কাছ থেকে সেই রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে ফের পরীক্ষা করা হচ্ছে পুরসভার ল্যাবে৷ এ জন্য বেসরকারি ল্যাবকে কয়েকদিন পর্যন্ত রক্তের নমুনা সংরক্ষণ করতে বলছে পুরসভা৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ সব ল্যাবের কর্তাদের দাবি, পুর পরীক্ষণাগারের পরিকাঠামো তুলনামূলকভাবে তাদের তুলনায় খারাপ৷ সেখানে শুধু টেকনিশিয়ান ও চিকিৎসকদের দিয়ে কাজ চলছে৷ এমডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্যাথলজিস্ট সেখানে নেই, যা বেসরকারি ল্যাবে রয়েছে৷ সুতরাং পুর ল্যাবের তুলনায় বেসরকারি সংস্থার রিপোর্ট বেশি নির্ভরযোগ্য বলে দাবি করছেন তাঁরা৷
ডেঙ্গু পরীক্ষার ক্ষেত্রে শহরের নামিদামি বেসরকারি পরীক্ষণাগারের এই আত্মবিশ্বাস থাকলেও গ্রামাঞ্চলে ছবিটা সে রকম নয়৷ সেখানে অধিকাংশ ল্যাবে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই৷ পশ্চিম মেদিনীপুরের মহকুমা শহর ঘাটালের অগ্রণী পরীক্ষণাগার চক্রবর্তী ল্যাবরেটরি৷ তার কর্ণধার, প্যাথলজিস্ট দেবাশিস চক্রবর্তী বললেন, ‘‘আমাদের এ সব এলাকায় ২০ শতাংশের বেশি ল্যাবকে নির্ভরযোগ্য বলা যাবে না৷ পরিকাঠামোর জন্য অনেক টাকার দরকার, একইসঙ্গে দক্ষ টেকনিশিয়ানকে বেশি বেতন দিতে হবে৷ এ সবের ব্যবস্থা করলে রক্ত পরীক্ষার জন্য বেশি টাকা ধার্য করতে হয়৷ সেটা গ্রামীণ এলাকায় মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার নিরিখে সম্ভব নয়৷''
জেলা শহর বা গ্রামের সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এত রোগীকে সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো নেই৷ সেখানে শুধু ডেঙ্গু নয়, সব ধরনের রোগীরই রক্ত পরীক্ষা করতে হচ্ছে৷ মূলত রক্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতি গুণমানে ফারাক গড়ে দিচ্ছে৷ দেবাশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এখানে শুধু স্ক্রিনিং টেস্ট করা হচ্ছে৷ ইনডিভিজুয়াল কিট বেশি চলছে, যা একবার ব্যবহার করা যায়৷ এলাইজা টেস্ট করতে হলে অনেক রক্তের নমুনা না হলে খরচে পোষাবে না৷ তাই এলাইজা পদ্ধতি এ সব এলাকায় অনুসরণ করা সম্ভব নয়৷''
ডেঙ্গুতে যখন ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে, সে সময় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে কাঙ্খিত বোঝাপড়া দেখা যাচ্ছে না৷ দেশের কোনো রাজ্যে কোনো রোগের প্রকোপ বাড়লে সেটা কেন্দ্রকে জানাতে হয়৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার ডেঙ্গু সংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্রের কাছে পাঠাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে৷ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে মাসখানেক রাজ্যে কতজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা কত, এ ব্যাপারে তথ্য মেলেনি বলে খবর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের৷
মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো ছাড়াও ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গু না লেখার জন্য সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা৷ এই অভিযোগকে স্বীকৃতি দিয়েছে একটি ফেসবুক পোস্ট৷
বারাসত জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক অরুণাচল দত্তচৌধুরী তাঁর পোস্টে লিখেছিলেন, ‘‘ডেঙ্গিতে মৃত্যু জেনেও পরিস্থিতির চাপে ডেথ সার্টিফিকেটে লিখতে হচ্ছে ফিভার উইথ থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া৷'' এ জন্য গত শুক্রবার তাঁকে সাসপেন্ড করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর৷ এ নিয়ে ফেসবুকে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
প্রবীণ চিকিৎসক অরুণাচলের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মীর ‘কোড অফ কন্ডাক্ট' ভাঙার অভিযোগ উঠলেও তাঁর অভিযোগ সত্যি কিনা, সে ব্যাপারে শাসক দল কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি৷
এই প্রতিবেদন প্রকাশের দিনও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর মিলেছে৷ এই পরিস্থিতিতে মশার থেকে সুরক্ষা পেতে রাজ্যের প্রতি আস্থা যে সাধারণ মানুষের ক্রমশ কমছে, সেটা বলে দিতে হয় না৷ তাই মশারি থেকে নানা সংস্থার অয়েল-কয়েল-স্প্রে-র বাণিজ্য বাড়ছে৷ গত একমাসে এ সব পণ্যের বিক্রি অনেক বেড়েছে৷
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু প্রশাসনের দিকে আঙুল না তুলে নিজেদেরও সচেতন হওয়ার সময় এসেছে৷ কিন্তু এত মৃত্যু সত্ত্বেও যে অনেকেরই টনক নড়েনি, তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে পাড়ায় পাড়ায়৷ পুরসভায় মাইক ফুঁকে প্রচার করলেও বাড়ির মধ্যেই পড়ে রয়েছে আবর্জনা, যত্রতত্র খোলা পাত্রে জমে রয়েছে বৃষ্টির জল৷
সব মিলিয়ে এই প্রতিকূল ও অসহায় পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গবাসী অপেক্ষা করছেন শীতকালের৷ জাঁকিয়ে শীত পড়লে মশার উৎপাত কমবে, ডেঙ্গুও এ মরশুমের মতো বিদায় নেবে — এই আশায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ৷
বন্ধু, বাংলাদেশেও তো ডেঙ্গুর প্রকপ কিছু কম নয়! তাই ডেঙ্গু নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷