পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা সংকট
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭কলকাতায় বাংলাদেশ হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার জকি আহাদ শুধু একজন কূটনৈতিক নয়, শহরের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আঙিনাতেও বেশ পরিচিত মুখ৷ সদাহাস্যময় জকির এই শহরে অনেক বন্ধু৷ হয়ত সেই ভরসাতেই, এবং যেহেতু কর্মসূত্রে তিনি এই শহরেরই বাসিন্দা, জকি তাঁর বাবা নুর আল-আহাদকে কলকাতার সবথেকে নামি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন গত ১৬ জানুয়ারি৷ বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং বরিশালের প্রাক্তন গভর্নর নুর আল-আহাদ স্নায়ুরোগে ভুগছেন৷ কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে থাকতে এখন তাঁর শরীরে আরও নানাবিধ রোগ সংক্রমণ হয়েছে, নানা শারীরবৃত্তীয় সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ এবং পরিবারের অভিযোগ, বহু লক্ষ টাকা খরচ করেও নুর আল-আহাদ কেমন আছেন, সেটা স্পষ্ট ভাষায় শোনা যাচ্ছে না৷ অবশ্য হাসপাতালে নিয়ম করে দু'বেলা মেডিকেল বোর্ড বসছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না৷
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বুধবার টাউন হলে কলকাতার সবকটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধিদের ডাকিয়ে চিকিৎসায় গাফিলতি, অবহেলা এবং শুধুই ব্যবসা করার যে অভিযোগ তুলেছেন, তা আদতে সাধারণ মানুষের অভিযোগ৷
ঘোর মমতা-বিরোধীরাও বলছেন, বেসরকারি বাণিজ্যিক চিকিৎসা ব্যবস্থার এই সরকারি শাসন অনেক আগেই দরকার ছিল৷ কিছু আপত্তি যদিও শোনা গেছে যে এত বেশি সরকারি ছড়ি ঘোরানো হলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নতুন লগ্নি আসা বন্ধ হবে, অথবা স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে কর্পোরেট পেশাদারিত্ব বিদায় নেবে৷ কিন্তু সেই বিরোধী স্বর এতই ক্ষীণ, যে সরকারি বক্তব্যের পক্ষে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বসিত সমর্থনের নীচে তা চাপা পড়ে যাচ্ছে৷ কারণ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন, এমন উদাহরণ বহু৷ এবং সেক্ষেত্রেও রোগীর পরিবারকে বিভ্রান্ত করে অকারণ, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করিয়ে বিলের অঙ্ক বাড়ানোর অভিযোগ অসংখ্য৷ সবথেকে পরিতাপের ব্যাপার যে তার পরেও অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি৷ কিন্তু পুরো টাকা মেটানো হয়নি বলে মৃতদেহ আটকে রাখা, বা মেডিকেল রেকর্ড পরিবারের হাতে না দেওয়ার মতো অমানবিক ঘটনা ঘটতেই থেকেছে৷
কিন্তু সরকারি বক্তব্যের সমালোচনাও হচ্ছে, বিশেষত চিকিৎসক মহলে৷ শহরের এক বড় বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত এক চিকিৎসক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বললেন, মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারি হাসপাতালকে বলছেন গরিবের চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে৷ কিন্তু বড় সরকারি হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতাল এবং ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এত বেহাল অবস্থা কেন, সে নিয়ে কেন কিছু বলছেন না! যদিও এই অভিযোগ ঠিক নয়, দাবি করছেন সরকারি হাসপাতালে যুক্ত চিকিৎসক ড. সুজন সরকার৷ তাঁর বক্তব্য, মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় আসার পর গত ছ'বছরে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে৷ যদিও রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের বক্তব্য, সরকারি হাসপাতালগুলিকে এখনও দালালচক্রের হাত থেকে মুক্ত করা যায়নি৷ সাধারণ মানুষ পরিষেবা নিতে গেলে এই দালালদের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে এখনও৷ আরও একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের খারাপ ব্যবহার৷ রোগীর পরিবারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার একাধিক ঘটনা যেমন ঘটেছে, ডাক্তাররাই স্বীকার করছেন যে এই দুর্ব্যবহারের কারণেই বহু রোগী চিকিৎসা করাতে চলে যান দক্ষিণ ভারতে৷ কারণ সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থার মানবিক সহানুভূতির জায়গাটি এখনও অটুট৷ চিকিৎসা হয়নি, অথচ ব্যবসা হয়েছে, এই প্রতারণার অভিজ্ঞতা দক্ষিণ ভারতের হাসপাতালগুলিতে নেই৷ এছাড়া পরিকাঠামোও এক বড় সমস্যা, জানিয়েছেন সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের নেতা সজল বিশ্বাস৷ পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র সরকারি হাসপাতাল ছাড়া সার্বিক, পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রায় নেই৷ যে কারণে এই রাজ্যের রোগীরা ভিন রাজ্যের চিকিৎসার ওপরেই এখন বেশি ভরসা রাখেন৷