পশ্চিমবঙ্গের ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী ঘিরে বিতর্ক
১১ এপ্রিল ২০২১শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে অতীতের অভিজ্ঞতায় শুরু থেকেই বাড়তি সতর্ক ছিল নির্বাচন কমিশন৷ ভোটের দিন ঘোষণার আগেই শুরু হয়েছে বাহিনীর টহল৷ শনিবার, চতুর্থ দফায় মোতায়েন করা হয়েছে ৭৯৩ কোম্পানি৷ তারপরও সহিংসতা থামানো যায়নি৷
সিআরপিএফ বনাম মমতা
আন্তর্জাতিক সীমান্ত কিংবা দেশের ভিতরে উপদ্রুত এলাকা অর্থাৎ জনতাকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সিআরপিএফের৷ সম্প্রতি ছত্তিশগড়ের বিজাপুরে মাওবাদী হামলায় নিহত হয়েছেন ২২ সিআরপিএফ জওয়ান৷ তাদেরই সহকর্মীরা পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন ভোটারদের সুরক্ষার কাজে৷ অতীতে অভিযোগ উঠেছে, বাহিনী এলেও পুলিশ তাদের বসিয়ে রাখে৷ এবার কমিটি করে তার হাতে বাহিনী পরিচালনার ভার দিয়েছে কমিশন৷ কিন্তু সিআরপিএফের কাজে অখুশি মমতা তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছেন৷ কোচবিহারের নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেন, ‘‘বিজেপির সিআরপিএফকে সম্মান করি না৷ কেন্দ্রীয় জওয়ানরা অশান্তি করতে এলে একদল ওদের ঘিরে ফেলুন৷ আরেক দল ভোট দিতে যান৷’’
এরই মধ্যে শনিবার, চতুর্থ দফার ভোটে কোচবিহারেই গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে সিআরপিএফের সদস্যদের বিরুদ্ধে৷ গুলি চালানোর ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে৷ গোটা ঘটনা খতিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছে কমিশন৷
কিন্তু মমতার এ ধরণের মন্তব্যের পিছনে কী কারণ? এর ব্যাখ্যায় তৃণমূল নেতা বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিআরপিএফের নামে যে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এসেছে, সেগুলোকে আমরা ফেলে দেব? যদি কোনো জায়গায় এরকম ঘটনা ঘটে, তাহলে লোকালি মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাবেই৷ যে জওয়ানদের শ্রদ্ধা করি, তারা যদি একটা দলের হয়ে কাজ করে বা মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে, তাহলে রিঅ্যাক্ট তো করবই৷’’ প্রসঙ্গত ভোটের আবহেই হুগলির তারকেশ্বরে নাবালিকার উপর যৌন নিগ্রহের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন এক সিআরপিএফ জওয়ান৷
বিরোধী মমতা বনাম শাসক মমতা?
বাম আমলে যখন মমতা বিরোধী নেত্রী, তখন বারবার ভোটলুটের অভিযোগ তুলেছেন৷ কেন্দ্রীয়বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্বাচন চেয়েছেন৷ তাই নরেন্দ্র মোদী প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘আপনি কেন আগে বাহিনী চাইতেন?’’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও একইসুরে বলেছেন৷ ‘‘রিগিং রুখতে একসময় সিআরপিএফদেরই চাইতেন মমতা দিদি৷ কিন্তু এখন ওদের বিরুদ্ধেই বলছেন৷ ওর জানার কথা যে, ভোটের কাজে মোতায়েন সিআরপিএফ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে কাজ করে না। কমিশনের অধীনে কাজ করে৷’’
কেন অবস্থান বদল করেছেন মমতা? দমদমের বিজেপি প্রার্থী অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মমতার আচরণ মুখ্যমন্ত্রীসুলভ নয়। বরং একজন সাধারণ রাজনীতিবিদের মতো৷ বিরোধী দলে যখন ছিলেন তখন মমতা প্রতিটি ক্ষেত্রে সিবিআই ও অনেক বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি করেছেন৷ এখন তিনি বুঝে গেছেন ক্ষমতায় না থাকলে দলের অস্তিত্ব থাকবে না৷ তাই সিআরপিএফ, সিবিআই তার এক নম্বরের শত্রু৷ এগুলো ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকার প্রচেষ্টা৷’’
বৈশ্বানর অবশ্য মনে করেন, ‘‘রাজনীতিবিদ যখন যে অবস্থানে থাকেন, তখন তার মতো করে বক্তব্য পেশ করেন৷ যখন সিপিএম ক্ষমতায় ছিল বা মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তারাও এমন বিরোধিতা করেছে৷’’
মমতার বক্তব্য ঘিরে বিতর্ক
মমতার ঘেরাওয়ের ডাক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কোনও মুখ্যমন্ত্রী কি এ কথা বলতে পারেন? মমতার বিরুদ্ধে কমিশনে নালিশ করেছে বিজেপি৷ বাহিনী নিয়ে মমতার মন্তব্যকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে কমিশন ব্যাখ্যা চেয়েছে মমতার কাছে৷ অবশ্য ভোট শুরুর আগেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কাঠগড়ায় তুলেছে তৃণমূল৷ বিএসএফ নিয়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন, সীমান্তের গ্রামে গ্রামে গিয়ে একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দেওয়ার জন্য ভয় দেখাচ্ছে বিএসএফ৷ এহেন মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক, বলতে ছাড়েননি মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল আরোরা৷ রাজনৈতিক দলগুলির এই প্রবণতা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক অনিন্দ্য বটব্যাল বলেন, ‘‘এটা অতীতেও বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে৷ বামফ্রন্টের সময়ে শাসকদল সিআরপিএফের ভূমিকা নিয়ে খুশি ছিল না৷ রাজ্য ও কেন্দ্রের ক্ষমতায় ভিন্ন দল থাকলে নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীকে রাজ্যের শাসকদল ভোটে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে৷ বরাবরই রাজ্যের শাসকদল দাবি করে, কেন্দ্রীয় বাহিনী কেন্দ্রের প্রতি পক্ষপাত দেখায়৷ এমনকি ভারতের অন্য রাজ্যেও নির্বাচনের সময়ে এই ছবি দেখা গিয়েছে৷’’ তবে অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ মনে করেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা হিংসা ছড়াতে পারে৷ তার কথা অনুযায়ী যদি ঘেরাও চলে, হামলা করা হয়, তাহলে তো নির্বাচন প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হবে৷’’
৬ এপ্রিলের ছবিঘর দেখুন...