পাকিস্তানে হিজড়াদের জন্য স্কুল
২৮ এপ্রিল ২০১৮পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো হিজড়াদের (বানানভেদে হিজরা) জন্য একটি স্কুল খোলা হয়েছে৷
গত সপ্তাহে স্কুলটিতে প্রথম পাঠদানের দিন স্কুলটির ২৫ জন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীসহ সমাজকর্মী, আইনজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন৷
পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর সিটিতে বেসরকারি সংস্থা এক্সপ্লোরিং ফিউচার ফাউন্ডেশন (ইএফএফ) ‘দ্য জেন্ডার গার্ডিয়ান' নামের এ স্কুল উদ্বোধন করে৷ পাকিস্তানে সংস্থাটির এটিই প্রথম প্রকল্প৷
ইএফএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোইজাহ তারিক বলেন, ‘‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত হিজড়াদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যক্রমের ব্যবস্থা থাকছে৷''
‘‘তাঁদের বেশিরভাগই ফ্যাশন শিল্পে আগ্রহ দেখিয়েছে৷ তাঁরা প্রসাধন, ফ্যাশন ডিজাইনিং, এমব্রয়ডারি ও সেলাইয়ের কাজ শিখতে আগ্রহী৷ কেউ কেউ গ্রাফিক ডিজাইন এবং রান্নার কাজ শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছে৷ আমরা প্রথমে তাঁদের কাছ থেকে এইসব তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং সে অনুযায়ী আমাদের কোর্স সাজিয়েছি৷''
২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়ায় হিজড়াদের একটি স্কুলে বোমা বিস্ফোরণ হয়৷
স্কুলের মালিক আসিফ শাহজাদ বলেন, ‘‘বিশ্বে মুসলিম কোনো দেশে হিজড়াদের একমাত্র স্কুল ছিল সেটি৷ ওই ঘটনার পর আমি হিজড়াদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেই৷''
এনজিওটি তাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের ডিপ্লোমা সনদ দেওয়ার পরিকল্পনাও করেছে, যাতে তারা চাইলে অন্য কোথাও চাকরির আবেদন করতে পারেন৷
এ স্কুলে ভর্তির কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই৷ আর এতে আপাতত চালু হয়েছে মোট আটটি বিভাগ৷ সামনেই স্কুলটিতে মূলধারার শিক্ষা চালুর প্রচেষ্টা রয়েছে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন৷
রক্ষণশীল পাকিস্তানে হিজড়া সম্প্রদায় নানা ধরনের সামাজিক বাধা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হন৷ সেই অর্থে তাঁদের কোনো অধিকারও নেই৷ ২০১৬ সালে লাহোরের আলিশা নামের ২৩ বয়সি একজন হিজড়া মানবাধিকার কর্মীকে সাতটি গুলি করে পেশওয়ারের এক হাসপাতালের সামনে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা৷
পরে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালের ভেতরে নেওয়া হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আলিশাকে ছেলেদের ওয়ার্ডে রাখা হবে, নাকি মেয়েদের ওয়ার্ডে রাখা হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে৷ চিকিৎসায় দেরি হওয়ার আলিশা মারা যান৷
তবে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের প্রান্তিক গোষ্ঠী হিজড়াদের নাগরিক ও মৌলিক অধিকার রক্ষার আইন তৈরি ও বাস্তবায়ন হচ্ছে৷
সংবিধানে হিজড়ারা সব ধরনের মৌলিক অধিকারের প্রতিশ্রুতি পেলেও ২০১১ সালে পাকিস্তানে প্রথম তাঁরা ভোটাধিকার পায়৷ আর পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ব্যুরো গত বছর আদমশুমারীতে তাদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ধরে আলাদা শ্রেণিতে গণনা করেছে৷
দেশটির বেশিরভাগ হিজড়াকেই তাঁদের পরিবার মেনে নেয় না এবং জোর করেই পরিবার থেকে তাঁদের বের করে দেওয়া হয়৷
এনজিও কর্মী শাহজাদ বলেন, ‘‘৯০ শতাংশের বেশি হিজড়া এই ধরনের সমস্যায় পড়েন৷ তাঁদের পরিবার তাঁদেরকে মেনে নেয় না৷ তাঁরা নিজেদের গুরুর সাথে বসবাস করেন৷ তাই স্কুলটি খোলার সময় আমরা কোনো হিজড়ার মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করিনি৷ আমরা সরাসরি তাঁদের গুরুর মাধ্যমেই তাঁদের সাথে যোগাযোগ করেছি৷''
স্কুলের ইংরেজি এবং কম্পিউটার বিষয়ক শিক্ষক ঈমান খান বলেন, ‘‘তাঁরা আমাদের মতোই মানুষ৷ তাঁরা সমাজে অবদান রাখতে পারে এবং আমাদের মতোই সাধারণ জীবনযাপন করার অধিকার তাঁদের রয়েছে৷''
ঈমান জানান, মানুষ হিসেবে সবারই সমান অধিকার রয়েছে পাকিস্তানিদের মধ্যে এ ধরনের সচেতনতা তৈরির জন্যই তিনি এখানে শিক্ষকতার পেশা বেছে নিয়েছেন৷ আর এ পথে এগোতে হলে সবচেয়ে বড় বাধার একটি হচ্ছে মানসিকতার পরিবর্তন৷ নতুন খোলা হিজড়াদের স্কুলটি সামাজিকভাবে একীভূতকরণের সেই সুযোগ দিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন৷ এছাড়া এটি অন্যান্য হিজড়া কমিউনিটিতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেও তিনি মনে করেন৷
এই স্কুলের আরেক শিক্ষক সানিয়া আব্বাসী৷ তিনি নিজেও হিজড়া৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রান্তিক হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য এটি একটি প্রাথমিক উদ্যোগ৷ আর তাই এতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসবে৷ কিন্তু এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ, যা পরিবর্তন নিয়ে আসবে৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এর কারণে সামাজিক, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে আসবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষক হিসেবে আমার সম্প্রদায়কে শক্তিশালী করতে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, কেননা, যখন তারা পরিপূর্ণ শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ নেবে, এটি তাদের চাকরি এবং অন্য অনেক কিছুর নিরাপত্তা দেবে৷''
শাহ মীর বালুচ/এইচআই
একটি সমাজে হিজড়াদের অধিকার নিশ্চিত করা কতটা জরুরি? লিখুন নীচের ঘরে৷