কলকাতা-মিউনিখ মেলবন্ধন
৮ মে ২০১২কলকাতা শহরে হাতে গোনা যে কয়েকজন মিউজিশিয়ান ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সংগীতের চর্চা করেন, এব্রাহাম মজুমদার তাঁদেরই একজন৷ সর্বশেষ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবং কলকাতা বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর পরিচালনায় সমবেত যন্ত্রসংগীত সবার হৃদয় জয় করেছিল৷ সম্প্রতি এব্রাহাম মজুমদারের টুপিতে যুক্ত হয়েছে আরও একটি নতুন পালক৷ ১০ জন বাদ্যযন্ত্রীর একটি দল নিয়ে তিনি কনসার্ট করে এলেন জার্মানিতে৷ ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সংগীতের নিজের দেশে কী শুনিয়ে এলেন, প্রশ্ন করেছিলাম এব্রাহাম মজুমদারকে৷ তিনি জানালেন, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালের দেশে গিয়ে ওঁদের বাজাতে কোনও অসুবিধা হয়নি, কারণ ওঁরা বরাবরই ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালেরই চর্চা করে এসেছেন৷ নিজেরা শিখেছেন এবং অন্যদেরও শিখিয়ে চলেছেন৷
কীভাবে যোগাযোগটা হল, তার উত্তর দিলেন এব্রাহামের স্ত্রী, ওঁদের সংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান কলকাতা মিউজিক অ্যাকাডেমি-র পরিচালিকা মধুশ্রী মজুমদার৷ মিউনিখ ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রার তরফ থেকে এব্রাহাম মজুমদারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল৷ সেই সঙ্গে কলকাতা মিউজিক অ্যাকাডেমির আরও কয়েকজন যন্ত্রসংগীত শিল্পীকে ওঁরা নিয়ে যেতে বলেছিলেন, ওঁদের অর্কেস্ট্রার সঙ্গে সমবেতভাবে বাজানোর জন্য৷ এবং ওঁরা বলেছিলেন, ভারতীয় ধ্বনি হলে ভাল হয়৷ এইভাবেই ১০ জনের দল নিয়ে এব্রাহাম মজুমদারের মিউনিখ যাওয়া এবং ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রার সঙ্গে বাজানো৷ একদিনে মোট তিনটে অনুষ্ঠান করেছিলেন ওরা৷ সকালে এব্রাহাম মজুমদারের সুরসৃষ্টি ‘টেগোর ইন সিম্ফনি' এবং সন্ধ্যায় ওডিওন ইউথ সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার সঙ্গে কলকাতার প্রথম বাংলা ব্যান্ড ‘মহিনের ঘোড়াগুলি'র গানের সুর৷ প্রতিটি বৃন্দবাদনেই কন্ডাক্টরের বেটন ছিল এব্রাহাম মজুমদারের হাতে৷
কেমন ছিল মিউনিখ ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রার সঙ্গে একসঙ্গে বাজানোর অভিজ্ঞতা? এব্রাহাম জানালেন, ঠিক যেমনটা উনি বরাবর বলে এসেছেন বা শিখিয়ে এসেছেন, যে, আগে সাংগীতিক শিক্ষাটা শেষ করে তবেই পরীক্ষা নিরীক্ষার দিকে যেতে হবে, সেটাই জার্মানিতে গিয়ে উনি দেখেছেন৷ যে শিক্ষা শেষ করার পরই সবাই সেটাকে আরও উন্নত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে৷ ফলে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, সুরের যে ভাঙচুর হয়েছে, সবই হয়ে উঠেছে অত্যন্ত গঠনমূলক৷
রবীন্দ্রসংগীতের চেনা সুরকেই ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সংগীতের ধাঁচে ঢেলে সাজিয়েছেন এব্রাহাম তাঁর সৃষ্ট ‘টেগোর ইন সিম্ফনি'তে৷ জার্মানির কেমন লাগল সেই নতুন ঘরানার সিম্ফনি৷ এব্রাহামের বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথের নিজের সাংগীতিক শিক্ষাও অংশত ইউরোপীয় ঘরানায় হয়েছে৷ তিনি যখন সুর রচনা করেছেন, পশ্চিমের বিখ্যাত সুরকারদের কাজ মাথায় রেখেই করেছেন৷ সেই গান পাশ্চাত্য রীতিতে সাজিয়ে নতুন যে সিম্ফনি রচনা করেছেন এব্রাহাম, তা বাজাতে কোনই অসুবিধা হয়নি মিউনিখ ফিলহারমনিকের যন্ত্রীদের৷ এবার হয়তো প্রথমবারে যদি ভাল নাও লাগে কারও, বাজাতে বাজাতে এই নতুন সাংগীতিক ধারার অনুভবটা তাঁদের নিশ্চয়ই হয়ে যাবে৷
ভবিষ্যতের কোনও যৌথ পরিকল্পনা কি হল মিউনিখ ফিলহারমনিকের সঙ্গে? এব্রাহাম এবং মধুশ্রী যা জানালেন, সেটা বেশ উৎসাহিত হওয়ার মতো৷ ওঁরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন যদি মিউনিখ ফিলহারমনিকের দলও কলকাতায় এসে একসঙ্গে একটা অনুষ্ঠান করে৷ তাতে ওঁরা সবাই উৎসাহ দেখিয়েছেন৷ ওডিওন ইউথ অর্কেস্ট্রার শিল্পীরাও কলকাতায় এসে বাজাতে আগ্রহী৷ এখন যেহেতু এই ধরনের অনুষ্ঠান বেশ খরচসাপেক্ষ, এব্রাহাম মধুশ্রী চেষ্টা করছেন যদি কোনও সরকারি বা বাণিজ্যিক আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করা যায়৷
হয়তো একদিন এব্রাহাম মজুমদার এবং ওঁদের কলকাতা মিউজিক অ্যাকাডেমির হাত ধরেই বাঙালি শ্রোতাদের সুযোগ হবে জার্মানির যন্ত্রশিল্পীদের বাজনা শোনার৷ সুযোগ তৈরি হবে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের এক সুরেলা মেলবন্ধনের৷
প্রতিবেদন: শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন