এত্তসব যন্ত্রণার মাঝেও ঈদ উৎসবে বর্ণিল ছিল গোটা বঙ্গীয় ব-দ্বীপ৷
উৎসবের আমেজের বাইরে ছিল না দেশের পার্বত্য জনপদও৷ বরং পুরো এলাকা জুড়ে ছিল উৎসব মুখরতা৷ এর অন্যতম কারণ গত দুটি বছর উৎসবের বাইরে ছিল পুরো দেশ৷
করোনা ভাইরাস মহামারি আঘাত হানলে সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষকে আটকে থাকতে হয়েছে চার দেয়ালের মাঝে৷ লকডাউন, শাটডাউন, স্ট্রিক্ট ভিউ, সামাজিক দূরত্ব নানা নতুন নতুন শব্দ এসময় পরিচিত হয়ে ওঠে করোনা ভাইরাসকে মোকাবিলায়৷ পুরো দেশজুড়ে তৈরি হয় অচলাবস্থা৷ ফলে ঈদ এলে প্রিয়জনের কাছে ফেরা, বাড়ি ফেরার যে আকুলতা, উদ্বেলতা সেটাও দেখা যায়নি গত দু বছরে৷
চারটি ঈদ আর দুটি বর্ষবরণ উৎসবের আনন্দ আয়োজন থেকে বঞ্চিত হয় গোটা দেশের মতো পাহাড়ের মানুষ৷ কিন্তু পাল্টে গেছে সে দৃশ্যপট৷ করোনা প্রতিরোধী টিকার দ্বিতীয় ডোজ শেষে চলছে বুস্টার ডোজ, সংক্রমণও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে, তাই নেই কোনো বিধিনিষেধ৷ মানুষ তার দুঃখ-কষ্ট, জীবন জীবিকার কথা ভুলে মেতে ওঠে উৎসবের রঙে৷ অন্তত বিপণি বিতান ঘুরে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে৷
অভিযোগ এসেছে এবারের পোশাকের মূল্য ছিল অন্যান্যবারের চেয়ে বেশি৷ কিন্তু তাতে আটকায়নি ক্রেতারা৷ দুই বছর ধরে সন্তানদের জন্য কিছু কিনতে না পারার আক্ষেপ, তাদের শৈশবের ঈদ চুরি যাওয়া দুঃখ ভোলাতে অভিভাবকরা ছিলেন বেশ উদার৷ সন্তানদের বায়না পূরণে দ্বিতীয় কথাটি ভাবেননি তারা৷
পাহাড়ি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল উৎসব বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু৷ এবারও সেই উৎসবে মেতেছে সবাই৷ কারণ ছিল না কোনো বিধি-নিষেধ৷ কিন্তু রমজান মাস চলমান থাকায়, সেই উৎসবে কিছুটা ভাটার টান ছিল৷ বাঙালি সম্প্রদায়ের বড় অংশ ইসলামধর্মানুসারী হওয়ায় তাদের আথিতেয়তা করা সম্ভব হয়নি পাহাড়িদের পক্ষে৷
ধর্ম-বর্ণ ভুলে যে নতুন বছর বরণের এ উৎসবে সব আয়োজন থেকেও এসব কারণে রঙ ছিল কিছুটা ফ্যকাশে৷ কিন্তু সেই আক্ষেপ ঘুচিয়ে দিয়েছে ঈদ৷
রাঙামাটি শহরে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করছেন তরুণ পরিবেশবাদী সংগঠক ফজলে এলাহী৷ তার সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, ‘জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির যে মান-অভিমান’ (শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে টানাপড়েন), উৎসবকে ঘিরে সেটার খুব একটা প্রভাব এবার পড়েনি রাঙামাটিতে৷
‘‘এছাড়া গত দু বছরের হিসাবটা দেখলেও বোঝা যায়, বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোনো খবর আসেনি৷ ফলে পারস্পরিক আস্থা ও ভরসা দেখা গেছে এবার পাহাড়ে৷ আর এ কারণে পাহাড়ে ঈদ উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে এলেও এবার যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা৷’’
ঈদের আগের রাতে কালবৈশাখী মৃদু আঘাত হেনেছে রাঙামাটিতে৷ তাতেও উৎসবের বর্ণিলতায় কোনো প্রভাব পড়েনি৷ তবে বাহারি পোশাকে শিশু-কিশোর থেকে বয়স্করা ছুটে গেছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে৷
পোশাকের কেনাকাটায় রাঙামাটিবাসী এখনও বারোয়ারি দোকানেরওপরই নির্ভরশীল৷ স্থানীয় টেক্সটাইল ছাড়া তেমন কোনো ব্র্যান্ডশপ এখানে গড়ে ওঠেনি৷ দেশীয় বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো আউটলেটও নেই এই শহরে৷ বেশিরভাগ পোশাক ব্যবসায়ী ঢাকা থেকে পাইকারি দরে নানা পোশাক কিনে এনে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করে৷
ব্যবসায়ীদের দাবি, পোশাক কেনা, পরিবহণখরচ, দোকান ভাড়া, কর্মচারির বেতন সব মিলিয়ে যেটুকু লাভ না করলে নয়, সেই লাভটুকু রেখে বিক্রি করছেন তারা৷ ফলে পোশাকের মূল্য কিছুটা বেশি হলেও সেখানে তাদের তেমন হাত নেই বলে জানালেন খুচরা ব্যবসায়ীরা৷
তাতে অবশ্য বিক্রি আটকায়নি৷ বর্ষবরণ উৎসব যেতে না যেতেই আবার ঈদ৷ সব মিলিয়ে জম্পেশ বিক্রি করেছেন তারা৷ তবে কেউ কেউ দাবি করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দ না হলেও আশানুরূপ বিক্রিটা হয়নি৷ তবে বেশিরভাগ বলেছেন, দুই বছর পর এই রমজানে ব্যবসা হয়েছে৷ আর তাতেই দারুণ সন্তুষ্ট তারা৷
তবে রাঙামাটি শহরের কেনা-বেচা আসলে অর্থের অংকে কত দাঁড়িয়েছে তা অবশ্য জানা যায়নি৷ তেমন কোনো পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়নি৷
তবে নিত্যপণ্যের বাজার ভুগিয়েছে সাধারণ মানুষকে৷ এমনিতে বাজার চড়া, তার ওপর ঈদকে সামনে রেখে কাঁচা মরিচ, শসা, টমেটো, গাজরের মতো পণ্যের দাম কেজিতে প্রায় ১০ থেকে ৩০টাকা
পর্যন্ত বেড়ে গেছে৷ সেমাইর বাজার কিনতে গিয়ে চিনিতে কেজি প্রতি গুণতে হয়েছে ৮০ টাকা, যা ছিল মরার খাড়ার ঘা৷
রাঙামাটিতে ব্যবসার মূল প্রাণ কাঠ, বাঁশ আর মাছ৷ এদিকে প্রজনন সুবিধার্থে কাপ্তাই লেকে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন৷ ফলে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপাকে৷ মাছ বিক্রি করে তাদের আয় বন্ধ আছে৷ আবার অন্য দিকে স্থানীয় মাছ না থাকায়, মাছের দাম ছিল বেশ চড়া৷ এক কেজি রুই মাছের দাম সাড়ে তিনশ ছাড়িয়েছে৷
ব্যবসায়ী কিরো চৌধুরী বললেন, ‘‘মানুষের হাতে নগদ টাকার সংকট আছে৷ নগদ টাকা না থাকলে, কিসের উৎসব, কিসের কী? কিন্তু অনেকদিন পর উৎসবকে জমকালো করতে অনেকে ধার-দেনা করেও বাজার করতে কার্পণ্য করেনি৷’’
ঈদের পর ৫ মে ছুটি নিলে সরকারি চাকরিজীবীদের ছুটি দাঁড়িয়েছে ৯ দিনে৷ ফলে দারুণ উপভোগের চেষ্টা ছিল সবার মধ্যে৷ এই সময়ে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষেরা ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের নানা প্রান্তে৷ যেহেতু রাঙামাটি পর্যটকদের তীর্থস্থান, ফলে ঈদের মধ্যে পর্যটকদের আনাগোণাও ছিল চোখে পড়ার মতো৷
রাঙামাটির স্থানীয় বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর মতে, ‘‘অনেক দিন পর এতটা উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে রাঙামাটিতে৷ গরমে কাপ্তাই লেকের জল শুকিয়ে গেছে৷ তাতে অবশ্য রূপ কমেনি লেকের৷ প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ বোট নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে এদিকে সেদিক৷’’
এ ছাড়াও জীবিকা, কিংবা পড়াশোনার প্রয়োজনে যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকেন, ঈদ ছুটিতে তারাও ভিড় জমিয়েছেন পাহাড়ে নিজ বাড়িতে৷ সব মিলিয়ে জম্পেশ ঈদ কাটিয়েছে পাহাড়ের মানুষ৷