পুরুষ অভিভাবক আইনের বলি
২২ এপ্রিল ২০১৭আপনি একবার ভাবুন তো আপনার জীবনে নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকলে কেমন লাগবে? আপনার জীবন সম্পর্কে প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নেবে বা ঠিক করবে৷ আপনি যতই প্রাপ্ত বয়স্ক হোন না কেন, অর্থাৎ আপনার বয়স ১৮, ৩০, ৪০ বা ১০০ – যাই হোক না কেন, যেহেতু আপনি একজন নারী, আপনার সাথে আচরণ করা হবে পরগাছার মতো, বরাবরই ভাবা হবে পরনির্ভরশীল৷ আর আপনি যাঁদের উপর নির্ভরশীল হবেন, তারা প্রত্যেকেই পুরুষ৷
অর্থাৎ আপনার জীবনের ভালো-মন্দ নির্ধারণ করবেন তাঁরাই৷ আপনাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁদের৷ আপনি হয়ত স্বপ্ন দেখছেন কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে পড়ালেখা করবেন, সেজন্য ভীষণ কষ্ট করে পড়ালেখা করলেন, রেজাল্টও ভালো হলো৷ কিন্তু হঠাৎ আপনি লক্ষ্য করবেন, আপনি যে বিষয়ে পড়ালেখা করবেন তা আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে৷ আপনি কাউকে ভালোবাসেন, তাঁকে বিয়ে করার কথা ভাবছেন...৷ কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আপনার নেই৷ দেখবেন, এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে, যাঁকে আপনি কখনো দেখেননি৷ কোনো চাকরি পছন্দ হলে সেটারও অনুমোদন লাগবে পরিবারের পুরুষ অভিভাবকের৷ বেশিরভাগ সৌদি নারীর জীবনেই ঘটছে এটা৷ এর কারণ ‘পুরুষ অভিভাবক আইন'৷ বিদেশে ঘুরতে গেলেও পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি লাগে সৌদি নারীদের৷
সৌদি নারীদের অনেকেই নিজেদের এই অনধিকারের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন৷ তাই এই আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন তাঁরা৷ গত বছর থেকে এ জন্যই শুরু করেছেন ‘স্টপ এনস্লেভিং সৌদি উইমেন' প্রচারণা৷ টুইটারে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে এর প্রচারণা চালাচ্ছেন তাঁরা৷ টুইটারে এই আইন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন অনেক সৌদি নারী৷ আরবী ভাষায় ব্যবহার করা ঐ হ্যাশট্যাগের অর্থ – ‘সৌদি নারীদের ক্রীতদাসী করা বন্ধ করো৷' এর মূল বক্তব্য, তাঁরা একজন সৌদি নাগরিক এবং সেদেশের একজন নাগরিকের যেসব অধিকার, সেটা তাঁদেরও প্রাপ্য৷
সম্প্রতি দিনা আলীর ঘটনার কারণে আবারও আলোচনায় এসেছে সৌদি আরবের এই আইনটি৷ অধিকার সংস্থাগুলোসৌদি নারীদিনার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যাকে ফিলিপাইন্স কর্তৃপক্ষ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে৷ দিনা আলী লাসলুম জোরপূর্বক বিয়ের হাত থেকে বাঁচতে অস্ট্রেলিয়া পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন৷
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে প্রত্যক্ষদর্শী এক ক্যানাডীয় নাগরিক জানিয়েছেন, ২৪ বছরের দিনা আলীকে ১১ এপ্রিল ম্যানিলা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সিডনিগামী ফ্লাইটে উঠতে দেয়নি৷ তারা বিমানবন্দরে আটকে দেয় তাঁকে৷ এরপর জোর করে তাঁকে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ যদিও দিনা ভয় পাচ্ছিলেন যে, তাঁকে দেশে ফেরত পাঠালে মেরে ফেলা হতে পারে৷ প্রত্যক্ষদর্শী ঐ নারী জানান, ম্যানিলা বিমানবন্দরে দিনা তাঁকে জানিয়েছিলেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁর পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং পাস বাজেয়াপ্ত করেছে৷
গণমাধ্যমকে তিনি জানান, তখন দিনাকে দিয়ে তিনি কয়েকটি ভিডিও তৈরি করেন, যাতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁকে সাহায্য করার আবেদন জানাতে পারেন৷ একটি ভিডিও এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে৷ যেখানে দিনা বলছেন, ‘‘আমার পরিবার যদি আসে, তারা আমাকে হত্যা করবে৷ সৌদি আরবে গেলে আমি মারা যাব৷ দয়া করে আমাকে সাহায্য করো৷''
তাঁকে আটক করা প্রসঙ্গে ভিডিওতে দিনা বলেন, ‘‘আমাকে একজন অপরাধী হিসেবে এখানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ আমার কিছু করার নেই৷''
বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীর বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, দিনাকে যখন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন৷ পরে ডাক্ট টেপ দিয়ে তাঁর মুখ ও হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ঐ নিরাপত্তাকর্মী৷ সংবাদ সংস্থা এএফপিকে এক সৌদি অ্যাকটিভিস্ট জানিয়েছেন, দিনা কুয়েতের অধিবাসী এবং তাঁকে রিয়াদে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং আটক করে রাখা হয়েছে৷ দিনাকে উদ্ধারের জন্য এক মেডিক্যাল শিক্ষার্থী আলা রিয়াদে গিয়েছিল, তাঁকেও গ্রেপ্তার করেছে কর্তৃপক্ষ৷
দিনাকে সাহায্য করতে না পেরে অনেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হতাশা ব্যক্ত করেছেন৷
ম্যানিলার সৌদি দূতাবাস এই ঘটনাকে ‘পারিবারিক ঘটনা' বলে উল্লেখ করেছে৷ টুইটারে তারা উল্লেখ করেছে, ঐ নাগরিককে তাঁর পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রিয়াদের কাছে দিনার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেয়েছে৷ এই ঘটনা চলাকালীন ফিলিপাইন্সের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ সফর করছিলেন৷
এপিবি/ডিজি (এপি, এএফপি)
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো বন্ধুরা? লিখুন নীচের ঘরে৷