পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেন শিরিন বানু মিতিল
১৪ মে ২০১১পাবনায় প্রাথমিক প্রতিরোধ পর্ব হয় একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকেই৷ চলে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত৷ ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা পাবনা শহরে ঢোকে৷ জারি হয় সান্ধ্য আইন৷ ২৬ মার্চ তারা রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে৷ সাধারণ মানুষের ওপরও নেমে আসে অত্যাচার৷ জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় পাল্টা আঘাত হানার৷ ২৭ মার্চ রাতে পুলিশ লাইনের যুদ্ধ শুরু হয়৷ সেই যুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে৷ ঘরে ঘরে মেয়েরাও যুদ্ধে নামার কথা ভাবতে শুরু করে৷ তাদের অস্ত্র ছিল গরম পানি, অ্যাসিড বাল্ব, বটি আর দা৷ শিরিন বানু মিতিলের মতো সংগ্রামী মেয়েদের মানসিকতা ছিল ‘মেরে মরো'৷
মিতিলের দুই চাচাতো ভাই জিন্দান ও জিঞ্জির যুদ্ধের ময়দানে রওনা হয় তাদের মায়ের নির্দেশে৷ এই মায়ের কথা না বললেই নয়৷ তিনি তাঁর ছেলেদের বলতেন, ‘তোমাদের কি মানুষ করেছি ঘরে থেকে অসহায়ভাবে মরার জন্য? মরতে হলে যুদ্ধ করতে করতে মরো৷'' তিনি ছিলেন পাবনা মহিলা পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির সভানেত্রী রাকিবা বেগম৷ এমন পরিস্থিতিতে মিতিলও ঘরে বসে থাকেননি৷ শার্ট প্যান্ট পরে কিশোর যোদ্ধা সেজে যুদ্ধে অংশ নেন৷ তাঁর সেই পুরুষের ছদ্মবেশে যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথাই তুলে ধরলেন ডয়চে ভেলের কাছে৷
২৮ মার্চ শহরের জেল রোডে টেলিফোন ভবনে দখলদার ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে যুদ্ধ হয়৷ যুদ্ধে পাক সেনাদের সবাই মারা পড়ে৷ দু'জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন৷ এভাবে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতেই থাকে৷ তখন যুদ্ধ চলছিল নগরবাড়ী ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরে৷ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয় আকাশপথে৷ পাশের জেলা কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ছে৷ তাদের বিভিন্ন দল পিছিয়ে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গার দিকে৷ পাবনার ছাত্রনেতা ইকবালের দল একটি গাড়িতে করে কুষ্টিয়া হয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে রওনা হয়৷ গাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মিতিল ও তাঁর এক ভাই থেকে যায় কুষ্টিয়ায়৷ পরে কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার সময় ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎ হয়৷ এরপর ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানস ঘোষ মিতিলের ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপেন৷ ফলে ছেলে সেজে যুদ্ধ করার আর সুযোগ পাননি মিতিল৷
একদিনের ঘটনা এখনও প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয় মিতিলের মন৷ তিনি জানান, ‘‘আমি যখন কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গার দিকে যাচ্ছিলাম৷ তখন একদিন গভীর রাতে আমাদের দলটিকে পথের মাঝে আটকানো হয়৷ মূলত ঐ অঞ্চলে পাক সেনাদের প্রতিরোধ করতেই সতর্কতামূলক পাহারায় যারা ছিল তারা আমাদের পরিচয় জানতে চায়৷ আমরা পরিচয় দিলেও তারা প্রথমে সেটা বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না৷ কারণ আমাদের সাথে যিনি আরআই ছিলেন তিনি ছিলেন পশ্চিম বঙ্গের৷ ফলে তাঁর ভাষার টান টা ছিল বিহারিদের মতো৷ তাই আমরা যে সত্যি মুক্তিযোদ্ধা তার প্রমাণ চাইল৷ তখন পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমাদের একজন বলতে বাধ্য হলো যে, ‘আপনারা কি আকাশবাণীতে শিরিন বানুর কথা শুনেছেন?' তারা বলল যে, ‘হ্যাঁ, আমরা তাঁর কথা শুনেছি৷' তখন বলা হলো যে, আমাদের সাথে সেই শিরিন বানু আছে৷ সেই সময় আমি খুব সন্দিগ্ধ ছিলাম যে, এতো বড় দলের ভেতরে ছদ্মবেশে একজন মেয়ে আছে, এটাকে তারা হয়তো অন্যভাবে দেখবে৷ কিন্তু আমার পরিচয় জানার পরেই দেখা গেল যে, তারা সবাই আমাকে ঘিরে ধরল৷ তাদের মধ্যে এক বৃদ্ধ পিতা আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা আমরা আর ভয় করি না৷ আমাদের মেয়েরা যখন আমাদের সাথে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে তখন বিজয় আমাদের হবেই৷' তাঁর এই কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম এবং তখন মনে হয়েছিল যে, সারাদেশের মানুষ কীভাবে স্বাধীনতার জন্য উদ্দীপনা ও উৎসাহ নিয়ে পরস্পরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে৷''
এরপর আরো প্রশিক্ষণের জন্য ভারত চলে যান মিতিল৷ নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের বাসায় কাটাতে হয়েছে তাঁকে কিছুদিন৷ প্রথমে কয়েকজন নারী বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল গঠন শুরু করেন৷ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন তিনি৷ অবশেষে ৩৬ জন নারী নিয়ে গোবরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু হয়৷ আস্তে আস্তে সদস্য সংখ্যা বেড়ে যায়৷ এক পর্যায়ে সদস্য ছিল ২৪০ এর ওপরে৷ সেখানে প্রশিক্ষণ নেন তিনি৷ পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলকাতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিতে থাকেন৷ অস্ত্রের অভাব থাকায় মহিলা গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না৷ তাই প্রথম দলের একটি অংশ আগরতলায় যায় মেডিক্যাল কোরের সদস্য হিসেবে৷ বাকিরা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক