প্রজাতন্ত্র দিবসেও বিতর্ক
২৬ জানুয়ারি ২০১৮বিতর্ক পিছু ছাড়ল না ৬৯তম প্রজাতন্ত্র দিবসেরও৷ শুক্রবার নতুন দিল্লির রাজপথে অনুষ্ঠিত হলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ৷ তবে অন্যবারের চেয়ে এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসের উদযাপন ছিল খানিক অন্যরকম৷ প্রতিবছরই বিশ্বের কোনো একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে আহ্বান জানানো হয় এই দিনে৷ কিন্তু এবার অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস বা আসিয়ান-এর ১০টি দেশের প্রতিনিধিদের অতিথি হিসেবে আহ্বান জানানো হয়েছিল৷ বস্তুত, বৃহস্পতিবারই দিল্লিতে আশিয়ানের বৈঠক হয়েছে৷ সেই উপলক্ষ্যে ওই ১০ দেশের প্রতিনিধি দিল্লিতে এসেছিলেন৷ শুক্রবারের কুচকাওয়াজেও তাঁদের সকলকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়৷
১০টি দেশের প্রতিনিধি একত্রে উপস্থিত হওয়ায় নিরাপত্তার বলয়ও অন্যবারের চেয়ে জোরদার করা হয়েছিল৷ সূত্রের খবর, কেবলমাত্র দিল্লি পুলিশেরই ৬০হাজার কর্মী প্রজাতন্ত্র দিবসের উদযাপনে মোতায়েন ছিলেন৷ এছাড়াও ছিলেন প্যারামিলিটারির জওয়ানরা৷ প্রতিটি উঁচু বাড়িতে বসানো হয়েছিল স্নাইপার৷ হেলিকপ্টার থেকেও প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে নজর রাখা হচ্ছিল৷ তাছাড়া প্রায় গোটা দিল্লি শহরই নাকাবন্দি করে ফেলা হয়েছিল দু'দিন আগে থেকে৷ অনুষ্ঠানের ছবি দিয়ে টুইটকরেন নরেন্দ্র মোদী৷
বিতর্কের শুরু অবশ্য অনেক আগে৷ ডিসেম্বরের ২২ তারিখ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর রাজ্যের প্রস্তাবিত ট্যাবলোটি বাতিল করে দিয়েছে কেন্দ্র৷ কিন্তু বাতিল করার কারণ জানানো হয়নি৷ নিয়ম হলো, প্রজাতন্ত্র দিবসের বেশ কয়েকমাস আগে রাজ্য সরকারগুলির নির্দিষ্ট দপ্তরকে কেন্দ্রের কাছে তাদের ট্যাবলোর প্রস্তাব পাঠাতে হয়৷ সেই মোতাবেক পশ্চিমবঙ্গের তরফ থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল গত সেপ্টেম্বর মাসেই৷ এক্সপার্ট কমিটির পরবর্তী বৈঠক হয় অক্টোবরে৷ সেখানেও পশ্চিমবঙ্গকে ডাকা হয়েছিল৷ ‘থিম' হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ পাঠিয়েছিল ‘একতাই সম্প্রীতি'৷ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, এরপর কেন্দ্র আর কোনো যোগাযোগ করেনি৷ পরবর্তীকালে রাজ্যকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, তাদের ট্যাবলোটি এবার রাখা যাচ্ছে না৷
উল্লেখ্য, প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে দিল্লির রাজপথে সৈন্যবাহিনীর প্রতিটি বিভাগের তরফ থেকে প্রথমে কুচকাওয়াজ হয়৷ এরপর বিভিন্ন রাজ্য নির্দিষ্ট থিমের উপর তৈরি তাদের ট্যাবলো সাজিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে৷ ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলো পুরস্কৃতও হয়েছিল৷ রাজ্যগুলির কাছে এই ট্যাবলো তৈরি একপ্রকার সম্মানেরই বিষয়৷ স্বাভাবিক কারণেই তাদের ট্যাবলো বাতিল হওয়ায় ক্ষুব্ধ হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাঁর অভিযোগ, বিজেপি সরকার ‘একতা' শব্দটিকে ভয় পায়৷ দেশ জুড়ে ঐক্য নয়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাঙনের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা৷ তাই পশ্চিমবঙ্গের ‘একতা' ট্যাবলোটিকেও বাতিল করা হয়েছে৷ বিষয়টি নিয়ে লাগাতার আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তবে কেন্দ্রের তরফ থেকে এ প্রসঙ্গে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি৷ এ বিষয়ে কেউ কথাও বলতে চাননি৷
বিশেষজ্ঞদের দাবি, কোনো রাজ্যের ট্যাবলো বাতিলের ঘটনা এই প্রথম নয়৷ দিল্লির ট্যাবলোও বহুবার বাতিল হয়েছে৷ বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলোও কয়েকবার বাতিল হয়েছে৷ কিন্তু তা নিয়ে কোনো মুখ্যমন্ত্রীই কখনো প্রতিবাদ করেননি৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতি করার জন্যই বিষয়টি নিয়ে আলোড়ন তৈরির চেষ্টা করছেন৷ তবে উলটো দিকের মতও আছে৷ কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিবাদ সময়োপযোগী৷ বিজেপি দেশ জুড়ে সত্যি সত্যিই বিভাজনের রাজনীতি করছে৷ অন্যদিকে, দিল্লিতে না গেলেও, একই ভাবনা নিয়ে কলকাতার রেড রোডে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করে৷ সেই ছবি টুইটারে পোস্টও করেন মুখ্যমন্ত্রী৷
এদিকে অন্য একটি প্রসঙ্গেও বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, ১০টি আসিয়ান রাষ্ট্রের একজন করে প্রতিনিধিকে পদ্মশ্রী দেওয়া হবে৷ ভারতের অন্যতম নাগরিক সম্মান পদ্মশ্রী৷ দেশের বিশিষ্ট মানুষদের এই সম্মানে ভূষিত করা হয়৷ কেন আসিয়ান রাষ্ট্রের একজন করে প্রতিনিধিকে এই সম্মান দেওয়া হবে, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন৷ তবে কূটনীতিকদের বক্তব্য, এটিও মোদীর একটি কূটনৈতিক চাল৷ আসিয়ান রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করার জন্যই এই পদক্ষেপ৷ এবং তাকে স্বাগত জানানো উচিত৷ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট প্রতিনিধিদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে৷
এই মুহূর্তে উপমহাদেশের রাজনীতি একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে৷ ডোনাল্ড ট্রাম্পের অ্যামেরিকা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে৷ বিশ্বের মঞ্চে পাকিস্তান এই মুহূর্তে খানিক কোণঠাসা৷ যার সদ্ব্যবহার করতে চাইছেন মোদী৷ আসিয়ান এবং সার্ক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে উপমহাদেশে নিজের শক্তি অনেকটা বাড়িয়ে নিতে চাইছে ভারত৷ অন্যদিকে অ্যামেরিকার সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখছে৷ ফলে আসিয়ান রাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিদের নাগরিক সম্মান জানানো একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত৷
বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক বিতর্ক তৈরি হয়েছে ভারতে৷ কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে অনেক৷ প্রজাতন্ত্র দিবসের বিবিধ বিতর্ক তারই সংযোজন হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা৷
এসজি/ডিজি (রয়টার্স/নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস/এনডিটিভি)