প্রতারণায় সর্বস্বান্ত পশ্চিমবঙ্গ
২৪ এপ্রিল ২০১৩পশ্চিমবঙ্গে চিট ফান্ডের জালিয়াতি কোনও নতুন ঘটনা নয়৷ কম সময়ে বেশি লাভের আশায় চিট ফান্ডে টাকা রেখে মানুষকে ঠকতে হয়েছে এর আগেও, যার শুরু হয়েছে সেই আশির দশক থেকেই৷ সঞ্চয়িতা, সঞ্চয়িনী, ভেরোনা, ওভারল্যান্ড – এরকম একাধিক নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের অর্থ লোপাট করে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে, সর্বস্বান্ত হয়েছেন মানুষ৷ মামলা অবশ্য দায়ের হয়েছে আদালতে, কিন্তু সেইসব মামলা আজও চলছে৷ তার পরেও যে মানুষ ফের চটজলদি লাভের আশায় চিট ফান্ডের উপরেই ভরসা করেন, তার সবথেকে বড় প্রমাণ, ভারতের কেন্দ্রীয় আর্থিক নিয়ামক সংস্থা সেবি-র হিসেব অনুযায়ী ৬০০টিরও বেশি চিট ফান্ড এখনও সক্রিয় এই রাজ্যে৷ যদিও তার মধ্যে চিট ফান্ড হিসেবে নথিভুক্ত সংস্থা মাত্র একটি৷ বাদবাকি সংস্থা নানা মুখোশের আড়ালে তাদের চিট ফান্ডের ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছে৷ এবারের চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির মূল পান্ডা সারদা রিয়েলটি ঠিক সেরকমই একটি সংস্থা, যারা জমি-বাড়ির ব্যবসার আড়ালে দাপটে চালিয়ে গিয়েছে চিট ফান্ডের কারবার৷
তবু এবারের চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি আলাদা মাত্রা পাচ্ছে অনেকগুলি কারণে৷ এক, এই সংস্থার কাছে যাঁরা টাকা জমা রেখেছিলেন, তাঁরা সবাই সাধারণ, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ৷ এঁদের কেউ দিনমজুরি করেন, কেউ বাজারের সবজি বিক্রেতা, কারও উপার্জন ভ্যান রিকশা বা ঠেলা চালিয়ে৷ প্রতিদিনের রোজগারের টাকা থেকে বাঁচিয়ে এরা আমানত গড়েছিলেন সারদার চিট ফান্ডে৷
দুই, এই সংস্থার যাঁরা এজেন্ট ছিলেন, তাঁরাও নেহাতই সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ, যারা কমিশন এবং ইনসেন্টিভের প্রলোভনে, দুটো টাকা বাড়তি রোজগারের আশায় নিজেদের আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী এবং সহকর্মীদের থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন৷
তিন, এই লগ্নিকারী এবং এজেন্ট মিলিয়ে সংখ্যাটা বেশ কয়েক লক্ষ, তবে ঠিক কত টাকা তাঁরা সারদার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেটা এখনও অজানা৷ কারণ, ওই আমানতের সঠিক কোনও হিসেব নেই৷ হিসেব রাখাই হয়নি৷ তবে সারদা রিয়েলটির মালিক সুদীপ্ত সেন তাঁর এই চিট ফান্ড ব্যবসার সুবাদে যে বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বানিয়েছিলেন, টাকার অঙ্কে সেটা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা৷ অবশ্য এটা নেহাতই রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের প্রাথমিক অনুমানভিত্তিক হিসেব এবং সেই বিরাট অঙ্কের টাকার কোনও হদিসই পাওয়া যায়নি এখনও৷
তবে এই আর্থিক কেলেঙ্কারির চতুর্থ মাত্রাটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ৷ রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা, মন্ত্রী ও সাংসদের নাম জড়িয়ে গিয়েছে সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে৷ বস্তুত আমানতকারীরা প্রত্যেকেই বলছেন, তৃণমূল তথা রাজ্য সরকারের নেতাদের সঙ্গে সারদা গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতা দেখে ভরসা পেয়েছিলেন বলেই তাঁরা তাঁদের যাবতীয় সঞ্চয় চিট ফান্ডে রেখেছিলেন৷ তৃণমূলের এক মন্ত্রী সারদা গোষ্ঠীর এজেন্টদের প্রকাশ্য সভায় সুদীপ্ত সেনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই সংস্থাকে তাঁরা বুক দিয়ে রক্ষা করবেন৷ তৃণমূলের এক নির্বাচিত সাংসদ-অভিনেত্রী ছিলেন সারদার ঘোষিত ব্র্যান্ড আম্বাসাডর৷ তৃণমূলের আর এক রাজ্যসভার সাংসদ-সাংবাদিক সারদা গোষ্ঠীর প্রায় ১০টি খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেলের সর্বেসর্বা ছিলেন৷ একদিকে এইসব কাগজ এবং চ্যানেল যেমন সবসময় তৃণমূল সরকারের গুণগান গাইত, সরকারও অন্যদিকে তাদের জন্য সরকারি বিজ্ঞাপনের বরাদ্দ বাড়িয়ে, সরকারি দপ্তর এবং পাঠাগারে ওই কাগজগুলি নিয়মিত কেনার বরাত দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করত৷
পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে, এত বড় মাপের আর্থিক কেলেঙ্কারি, এত বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষের অর্থ নিয়ে নয়ছয়, এবং গোটা ঘটনায় তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় স্পষ্টতই বেকায়দায় সরকার৷ বিরোধী বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসও গোটা বিষয়টা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ তো শানাচ্ছেই, কিন্তু ক্ষিপ্ত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ৷ গ্রামে শহরে গত এক সপ্তাহ ধরে তুমুল বিক্ষোভ, অবরোধ, ভাঙচুর শুরু হয়েছে৷ জনরোষের হাত থেকে বাঁচতে একাধিক এজেন্ট আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, দুজন মারাও গিয়েছেন এবং প্রায় সবাই আতঙ্কে ঘরছাড়া৷ এবং দলমতনির্বিশেষে লোকে দুষছেন সরকার ও তার নেতা-মন্ত্রীদেরই৷
এমন অশান্ত পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমত হতাশ করেছেন৷ এক তো তিনি বলেছেন, যা হবার তা হয়ে গেছে, সরকার এবার নতুন আইন আনছে চিট ফান্ডের বিরুদ্ধে৷ এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন এজেন্ট ও আমানতকারীরা৷ তার উপর তাঁদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী যে, এত বিক্ষোভ-আন্দোলন আসলে সিপিএম ক্যাডারদের সাজানো নাটক৷
এসবের মধ্যে একটাই সুখবর যে ১০ দিন ফেরার থাকার পর মঙ্গলবার কাশ্মীরে ধরা পড়েছেন সুদীপ্ত সেন৷ তাঁকে জেরা করে যদি তাঁর গোপন আমানত উদ্ধার করা যায়. তা হলে বহু লোকের সঞ্চয় ফেরত পাওয়ার একটা সম্ভাবনা অন্তত তৈরি হবে৷ অবশ্য তৃণমূল সরকারের সংকট সেখানেও যে কোণঠাসা সারদা-মালিক তাদের কোন নেতা-মন্ত্রীর নাম ফাঁস করে দেন পুলিশের কাছে৷