1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রতিহিংসার বড় অস্ত্র ধর্ষণ!

৫ জানুয়ারি ২০১৯

ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি সংবাদের লিংক৷ নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় স্বামী ও চার সন্তানকে বেঁধে রেখে গৃহবধুকে গণধর্ষণ৷ ধর্ষণ শব্দটি শুনলে যেকোনো নারীরই তীব্র অসহায় লাগে, অনিরাপদ অনুভূতি মাথা চাড়া দেয়৷

https://p.dw.com/p/3B2o9
Symbolbild Gruppenvergewaltigung in Indien
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Maqbool

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে আমরা মানবিক হওয়ার পরিবর্তে পাশবিক হয়ে উঠছি৷ পাশবিক আচরণের যে ধারা আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া, সেটি থেকে বের হতে পারিনি আমরা৷ আর সেটির বড় শিকার নারীর সম্ভ্রম৷ এর বড় প্রমাণ পূর্ণিমা শীল, পারুল কিংবা বগুড়ার সেই মা-মেয়ে৷

সুদূর অতীতে না গিয়ে আমরা ২০০১ সালের নির্বাচনেই যাই, পূর্ণিমা শীল আমাদের কাছে এক জ্বলন্ত উদাহরণ৷ ‘সব হিন্দুরা আওয়ামী লীগে ভোট দেয়' তাই বিএনপির কর্মী খলিল, লিটন, আলতাফদের কাছে ধর্ষণ করেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা সহজ ছিল৷ সেটাই ঘটেছিল৷ আর আমাদের কানে বেজেছে পূর্ণিমার মায়ের আর্তনাদ, ‘বাবারা তোমরা একজন একজন করে আসো, আমার মেয়েটা ছোট ও মরে যাবে'৷ এই নারকীয় ঘটনার ১৭ বছর পর পূর্ণিমার সঙ্গে একদিন দীর্ঘসময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিলো৷ তাকে জড়িয়ে ধরে আমি শুধু ‘দুঃখিত' উচ্চারণ করতে পেরেছিলাম৷ আমার ব্যক্তিগত অক্ষমতা হয়তো এতে খানিকটা প্রশমিত হয়েছিল৷ কিন্তু পূর্ণিমার ক্ষত গত ১৮ বছরে একই আছে৷ পূর্ণিমা হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আমার কিসের লজ্জা, এ লজ্জা রাষ্ট্রের৷' 

পূর্ণিমাদের সাজানো সংসার ছিল, বোনেদের বিয়ে হয়েছিল৷ বোন ধর্ষিত হয়েছে এই অপরাধে ফিরতে হয়েছিল পূর্ণিমার বোনদের৷ এলাকা ছাড়া হতে হয়েছিল পরিবারকে৷ এতদিনের সাজানো সংসার ছেড়ে পূর্ণিমার মাকে শুধু বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল৷ সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে পূর্ণিমা আজ সমাজের মুখে থুতু দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে কিন্তু সমাজ কী সংশোধিত হয়েছে৷ আজও পূর্ণিমাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেনস্থা হতে হয়, কারণ তিনি ধর্ষিতা হয়েছিলেন৷ তাঁর ছবি, ফোন নম্বর ব্যবহার করে খোলা হয় পর্ন পেইজ৷ তাঁর দোষ একটাই, ধর্ষিত হয়ে তিনি সিমি বেগম বা সীমাদের মতো মরে যাননি, বেঁচে আছেন৷

এই ধারাবাহিকতায় নিকট অতীত ঘাটলে পাই বগুড়ার ঘটনা৷ দলীয় ক্যাডার দিয়ে একজন কিশোরীকে তুলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ কয়েকদিন পর আবারো ক্যাডার দিয়ে বাড়ি থেকে তুলে এনে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি ও তার মায়ের মাথার চুল কামিয়ে দেয়া হয়েছে৷ এরপর মা মেয়ে বাড়ি ছাড়া, তিন মাস কাটাতে হয়েছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে৷

শুধু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বলে চাইলেই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটানো যায়? আর রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা ধর্ষণকেই কেনো প্রতিহিংসার বড় অস্ত্র হিসেবে লালন করেন এই প্রশ্নের কোনও ব্যাখ্যা বা জবাব কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি৷

মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে আমাদের পাওনা ২ লাখ বীরাঙ্গনা৷ যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করার পাশাপাশি নিজেদের পৌরুষত্বের জোর পরীক্ষা করে বীরাঙ্গনাদের নারকীয় দুঃসহ জীবন ‘উপহার' দিয়ে গেছে সেই পাষণ্ডরা৷ স্বাধীন দেশে তার পুনরাবৃত্তি চলছেই৷ 

সৌদি আরবে ধর্ষণের শিকার নারী

নিজ দেশের মানুষই কেবল ভোটাধিকার প্রয়োগের জের ধরে চার সন্তানের সামনে গণধর্ষণ করতে পারে৷ সুবর্ণচরের সেই নারীর স্বামীর দেওয়া বয়ান শোনার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যেটাই বলেন সেটা হয়েছিল৷ অসহায় সে পুরুষ নিজ স্ত্রীকে ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি৷ নিম্নবিত্ত এই পরিবারটির বাস্তবতাটি কী কেউ খতিয়ে দেখছি! কোথায় যাবেন তারা? আমাদের সমাজ কী তাকে মেনে নেবে? বিয়ে হবে সেই নারীর সন্তানদের? পূর্ণিমাকে যেমন একঘরে করা হয়েছিল, তেমনটি হবে না? বাস্তবে তেমনটিই হবে৷ আমাদের সামাজিক ও কূপমণ্ডুক বাস্তবতা ধর্ষিতাকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করবে আচরণ দিয়ে৷ আর প্রতিহিংসা চরিতার্থের যেসব উদাহরণ রেখে যাচ্ছে আমাদের তথাকথিত রাজনীতিকরা, সেটিই চর্চিত হবে বারংবার৷

পূর্ণিমা বা পারুলদের খবর আমাদের পর্যন্ত এসেছে৷ কিন্তু আরও অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা কেবল ধর্ষকের সামাজিক ও রাজনৈতিক দাপটের জোরে প্রকাশিত হয় না৷ ধর্ষণের মামলা হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই৷

২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে  নারী ও শিশু ধর্ষণ সংক্রান্ত ১৭ হাজার ২৮৯টি মামলা হয়েছে৷ এসব মামলায় ভিকটিমের সংখ্যা ১৭ হাজার ৩৮৯ জন৷ এর মধ্যে ১৩ হাজার ৮৬১ জন নারী ও তিন হাজার ৫২৮জন শিশু৷ তিন হাজার ৪৩০টি ধর্ষণ মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে৷ নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৮০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫৭৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাসহ ৬৭৩ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে৷ 

Fatema Abedin, Intern, DW Bangla section.
ফাতেমা আবেদীন নাজলা, ডয়চে ভেলেছবি: privat

এবার আসুন পরিসংখ্যানে আসি৷ প্রায় সাড়ে তিন হাজার ধর্ষণ মামলার ঘটনায় সাজা পেয়েছেন মাত্র এক হাজার ৩৪৬ জন৷ অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি মামলা ধোপে টেকেনি৷ ধর্ষিতা প্রমাণ দিতে পারেননি তিনি ধর্ষিত হয়েছিলেন৷ সুতরাং সাজা হয়নি আসামির৷

আসামি ধর্ষণ করেনি এমন প্রমাণের ভিত্তিতেই ছাড়া পেয়ে গেছে৷ ধর্ষিতা কিন্তু সমাজ ও সংসারের চোখে ধর্ষিতা হয়েই বেঁচে আছেন৷ কোথায় কেমন আছেন সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই৷ হয়তো শিগগিরই রুহুল আমিন প্রমাণ করতে পারবেন তিনি ও তার সঙ্গীরা  পারুলের গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না৷ কিন্তু পারুলের যে তকমা লেগে গেছে৷ সেটি তো আর  মুছবে না৷

তবে যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তার প্রায় ৭০ শতাংশ বিচারের দ্বার পর্যন্ত আসে না৷ আমাদের সমাজের বিভিষীকাময় আচরণের কাছে বেশিরভাগ পিতামাতা ও স্বজন লুকিয়ে ফেলেন ধর্ষণের ঘটনা৷ এমনটাই ঘটে এসেছে৷ প্রকাশ্য কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে হয়তো এভাবেই লুকিয়ে থাকতে হবে ধর্ষিতাকে৷ আর প্রতিহিংসা চরিতার্থের অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণ পুরুষদের প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচিত হবে৷ কারণ এই অপরাধে তো শাস্তির নজির নেই৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷