প্রতিহিংসার রাজনীতি কি বন্ধ হবে?
১০ নভেম্বর ২০১৭বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে৷ গ্রেপ্তার, হামলার শিকার হয়েছেন তাঁরা৷ এমনকি এখনকার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও মামলা হয় তখন৷ এখন আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়৷ এই সময়ে বিএনপির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, হচ্ছে৷
বিএনপি শাসনামলে এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট ১৫টি মামলা হয়৷ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হয় মামলাগুলো প্রত্যাহার, নয়তো খারিজ হয়ে গেছে৷ এসময় রাজনৈতিক মামলা বিবেচনায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ওই সময় দায়ের করা কয়েক হাজার মামলা প্রত্যাহার হয়৷ ২০০৯-১৩ মেয়াদে আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকারের আমলে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় ৭ হাজার ১৯৮টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের সুপারিশ করা করা হয়৷ এই আমলেও তা অব্যাহত আছে৷
তবে ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও একই কায়দায় ৫ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং ৯৪৫টি মামলা থেকে কিছু আসামিকে অব্যাহতি দেয়৷ ওই সময় মোট ৭৩ হাজার ৫৪১ জন আসামি এই প্রক্রিয়ায় বিচার এড়াতে সক্ষম হন৷
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এখন দুর্নীতি, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানিসহ মোট ৩৫টি মামলা রয়েছে৷ এরমধ্যে দুর্নীতির মামলা পাঁচটি৷ এই পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে৷ বাকি মামলা দায়ের হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে৷ দুর্নীতির মামলাগুলোর বিচার চলছে৷
বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়া আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে চতুর্থ দিনের বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘‘প্রতিহিংসার বিপরীতে সংযম ও সহিষ্ণুতার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা আমরা বারবার করে এসেছি৷ কিছুদিন আগেও আমি সংবাদ সম্মেলনে অতীতের তিক্ততার কথা তুলে ধরেছি৷ আমার ও শহিদ জিয়ার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ক্রমাগত অশোভন উক্তি, প্রতিহিংসামূলক বৈরি আচরণ সত্ত্বেও আমি ক্ষমা করে দিয়েছি৷ আমি তার প্রতি কোনও প্রতিহিংসামূলক আচরণ করবো না৷’’
খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন তাঁর উপদেষ্টা বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ গত ৯ বছরে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়েছে৷ নেতা-কর্মীরা, হত্যা, গুম এবং অপহরণের শিকার হয়েছেন৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে যায় এবং আমাদের অত্যাচার, নির্যাতন ফিরে আসে তাহলে পরিস্থিতি কী হবে? আর সেকারণেই খালেদা জিয়া ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলেছেন৷ আমাদের নির্যাতন, নিপীড়নের প্রতিবাদে আমরা কোনো প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার রাজনীতি করবনা৷’’
তিনি দাবি করেন, ‘‘গত ৯ বছরে এই সরকার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৩৮ হাজার মামলা করেছে৷ আর এইসব মামলায় বিএনপির অন্তত ১০ লাখ নেতা-কর্মী নির্যাতিত হয়েছেন, জেল খেটেছেন৷ এক হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গুম হয়েছেন৷ বিএনপি'র সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করে ডান্ডাবেড়ি পড়ানো হয়েছে৷ এরকম বহু লোমহর্ষক নির্যাতনের প্রমাণ সরকারের কাছে আছে, আমাদের কাছেও আছে৷’’
এর জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না৷ তাই কারুর ক্ষমা করে দেয়ার প্রশ্ন ওঠেনা৷ বরং বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতি করে৷ বিএনপি প্রতিহিংসা দিয়েই রাজনীতি শুরু করেছে৷ তাই খালেদা জিয়ার কথা হাস্যকর৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপির শাসনামলে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ২৬ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে৷ তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া, সংসদ সদস্য আহসানুল্লাহ মাস্টার, নাটোরের সাবেক এমপি মমতাজ আহমেদ, খুলনার মেয়র প্রার্থী মঞ্জুরুল ইমামের মত সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করানো হয়েছে৷ ওনার (খালেদা জিয়া) সরকারের তত্ত্বাবধানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়৷ সেই হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন৷ এখনো ৮০ জন নেতা-কর্মী স্প্রিন্টারের আঘাত নিয়ে এখন পঙ্গু জীবন যাপন করছেন৷ আর এই হামলার পর আমাদের মামলা করতে দেয়া হয়নি৷ তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি করেন বলেই ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন না হওয়ার পরও ওইদিন জন্মদিন পালন করেন৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ দাবি করেন, ‘‘এই সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি৷ তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে৷ উনি আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হলে আরও খুশি হব৷’’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসার রাজনীতি একটি বড় সংকট৷ এটি দূর করা সুস্থ রাজনীতির পূর্বশর্ত৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থা এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি করতে হবে৷ আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দুটি দলের ভূমিকাই প্রধানভাবে দেখেছি৷ তাই তাদেরই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মামলা ও বিচারের বিষয়টি আইনের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত৷ প্রশাসন এবং বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন হয় তাহলে প্রকৃত অপরাধী ও দুর্নীতিবাজরা শাস্তি পাবে৷ যদি রাজনৈতিক কারণে মামলা দায়ের ও তা প্রত্যাহার করা হয় তাহলে তার সুযোগ নেয় প্রকৃত দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীরা৷ তারা এই সুযোগে ছাড়া পেয়ে যায়৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...