অ্যাসিড ছোড়া নয়
৭ আগস্ট ২০১৩ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, কোনো ক্রেতাকে অ্যাসিড কিনতে হলে ফটো আইডি দেখাতে হবে এবং বিক্রেতা, ক্রেতার নাম এবং ঠিকানা লিখে নিবন্ধন করে রাখবেন৷ অ্যাসিড নিক্ষেপের ফলে কোনো মানুষের ত্বক পুড়ে যায় এবং গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়৷ এসব হামলার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকায় এসব অপরাধের কোনো সঠিক পরিসংখ্যানও নেই৷ তবে ‘স্টপ অ্যাসিড অ্যাটাকস' ক্যাম্পেনের জরিপ অনুযায়ী, ভারতে প্রতি সপ্তাহেই তিন থেকে চারটা অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটে৷ রাজধানী নতুন দিল্লি ভিত্তিক এই সংগঠনটি তাই আইন আরো কঠোর করার এবং সমাজ বদলানোর পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে৷
প্রশ্ন (ডিডাব্লিউ): কিছুদিন আগেও ভারতের রাস্তায় রাস্তায় অ্যাসিড বিক্রি হতো, যা কেনা খুব সহজ ছিল এবং অস্ত্র হিসেবে দামেও ছিল সস্তা৷ নতুন এই আইন হওয়ার ফলে কি অ্যাসিড হাতে পাওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন?
উত্তর (সুনিত): অপরাধের লাগাম টেনে ধরার এটা প্রথম ধাপ৷ তবে ভারতের গ্রামে এবং শহরেও ছোট ছোট দোকানে অনেক মানুষ অ্যাসিড বিক্রি করে৷ তাই আমি দেখেছি, এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে কাজ হয় না৷ ১৮ই জুলাই সুপ্রিম কোর্ট এই রুল জারি করেছে৷ অথচ সে সময় থেকে এ পযর্ন্ত ভারতে মোট চারটি অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে৷
প্রশ্ন: রাস্তার দোকান থেকে অ্যাসিড কেনা-বেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না কেন?
উত্তর: কেননা টয়লেট এবং নদর্মা পরিষ্কারের জন্য অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়৷ ধরে নিলাম, এসব কাজে অ্যাসিড ব্যবহার বন্ধ করা গেল, কিন্তু রঙের কারখানা, কাচ শিল্প, ব্যাটারি তৈরিতে অ্যাসিড লাগবেই৷ তাই এসব জায়গা থেকে অ্যাসিড পাওয়ার সম্ভাবনাটা অনেক বেশি৷
প্রশ্ন: অ্যাসিড বিক্রির ক্ষেত্রে কেন প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয় না?
উত্তর: কেবল প্রত্যন্ত এলাকাতেই না, ভারতের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে যে, কোনো নিয়ম ছাড়াই রাজধানী দিল্লিতেও অবাধে অ্যাসিড বিক্রি হয়৷ সেখানে সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পরও অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ ফলে বলাই বাহুল্য, ভারতে কোনো আইন পাস হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন কতটা কঠিন৷ এতে অপরাধ কিছু ক্ষেত্রে কমানো গেলেও অ্যাসিড বিক্রি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না৷ আগে যেখানে ১০টি অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটত, এখন সেখানে হয়ত ছয়টি থেকে আটটি ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে৷ তবে এটা নিশ্চিত এ ঘটনা থামানো সম্ভব নয়৷
প্রশ্ন: হামলা বন্ধে কি কি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি?
উত্তর: ভারতে এই অপরাধের পেছনে প্রধানত কাজ করে এখানকার শক্তিশালী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা৷ আমরা আমাদের নারীদের সাথে কেমন আচরণ করব, তা নিয়ে এখানে ব্যাপক সমস্যা রয়েছে৷ প্রতিটি মানুষের সহানুভূতিশীল হতে হবে৷ তারা আসলেই এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না, অপরাধগুলোকে মেনে নেয়৷ হামলার স্বীকার হওয়া মানুষটা কতটা যন্ত্রণা ভোগ করছেন, তাঁর জীবনটা যে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই৷ এসব মানুষ হামলার পরে তিন-চার বছর বাড়ি থেকেই বের হয় না৷ কেন না তাঁদের প্রচুর চিকিত্সা প্রয়োজন৷ এমন অনেক নারী আছেন, যাঁরা তাঁদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন কান৷ কারো কারো অ্যাসিডে নষ্ট হয়ে গেছে নাক, নষ্ট হয়ে গেছে চেহারা৷
প্রশ্ন: সব কিছু মিলিয়ে আদালতের এই নির্দেশে আপনি কি সন্তুষ্ট?
উত্তর: না, আসলেই না৷ কারণ ২০০৫ সালে অ্যাসিড হামলার শিকার লক্ষী একটি পিটিশন ফাইল করেছিলেন৷ সাত বছর কাজ করার পর ২০১২ সালে ভারতের পেনাল কোড অনুযায়ী অ্যাসিড হামলাকে আলাদা সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷ এবং এর উপর ভিত্তি করে চলতি বছর এই নির্দেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্ট৷ সুতরাং এটি অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া৷
যখন আমরা এসব নারীদের পুনর্বাসন নিয়ে কথা বললাম, আদালত আবারো আগামী চার মাসের জন্য শুনানি স্থগিত করে দিল৷ হয়ত আরো দু'বছর লেগে যেতে পারে পুনর্বাসনের ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্ত নিতে৷ হামলায় বেঁচে যাওয়া এমন অনেক নারীদের নিয়ে আমরা কাজ করছি, যাঁরা তাঁদের জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন৷ তাঁদের জন্য কোনো তহবিল নেই, নেই কোন কমর্সংস্থান৷
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয়, কি কারণে আদালতে এসব মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় লাগায়?
উত্তর: সত্যি কথা বলতে গেলে, সরকার আসলেই এ বিষয়ে আগ্রহী নয়, তাদের কাছে এটা এতটা সংবেদনশীল ইস্যু নয়৷ বাংলাদেশের সরকার কিন্তু এরই মধ্যে অ্যাসিড বিক্রি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে৷ এর জন্য কিন্তু আদালতের নির্দেশের প্রয়োজন পড়েনি৷ কিন্তু ভারতে, কেবল একবার নয়, তিন-তিনবার সরকারের প্রতি নির্দেশ জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট৷
প্রশ্ন: আপনি অবশ্য সমাজকে শিক্ষিত করার করা বলছিলেন৷ এসব নারীরা তো কোনো অচেনা ব্যক্তি, চেনা মানুষ বা তাঁদের ভালোবাসার মানুষটির দ্বারা অ্যাসিড হামলার শিকার হন৷ তাঁদের কিভাবে এসব মানুষের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব?
উত্তর: আইন ও নিয়ম-কানুন দিয়ে এই অপরাধকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়৷ বরং মানুষের চিন্তায় পরিবর্তন আনাটা জরুরি৷ নারীদের প্রতি মানুষের আচরণ ও চিন্তা-ভাবনাকে বদলাতে হবে৷ যেসব পুরুষরা নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, তাঁদের বোঝাতে হবে যে, কোনো নারীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হলেই তাঁদের চেহারায় ক্ষত তৈরি করা উচিত নয়৷ এই অধিকার তাঁদের কেউ দেয়নি৷ তাঁদের বোঝাতে হবে, তুমি যাঁকে ভালোবাস তাঁর ক্ষতি তুমি করতে পারো না৷ এসব পথ নাটক, টেলিভিশন শো বা সামাজিক নেটওয়ার্ক সাইটগুলিতে প্রচারের মাধ্যমে সমাজকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যেটা আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য৷
সরকারের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় যাওয়াটা আমাদের জন্য জরুরি৷ অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা, কঠোর আইন পাস করা এবং হামলার শিকার হওয়া নারীদের পুনর্বাসনের জন্য এই লড়াইটা প্রয়োজন৷ এই নারীদের এটা উপলব্ধি করাতে হবে যে, হামলায় তাঁদের জীবন শেষ হয়ে যায়নি, অনেক কিছু করার আছে, এই দুঃস্বপ্ন থেকে তাঁরা বের হয়ে আসবেন এবং হামলার আগে তাঁরা জীবন নিয়ে যতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, ততটাই আত্মবিশ্বাসী হবেন৷
সাক্ষাৎকার: সারাহ স্টেফেন/এপিবি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ