নারী কোটিপতি
১৫ জানুয়ারি ২০১৩১২ই জানুয়ারি, মঙ্গলবার সারা ভারত দেখলো ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি' বা কেবিসি-র সেটে কীভাবে ইতিহাস গড়লেন সনমিত কৌর সাহানি৷
পরনে হাল্কা গোলাপী আর নীল রঙের সাদা-মাটা একটা সালোয়ার-কামিজ৷ বলিউডের ‘বিগ বি' অমিতাভ বচ্চন নাম ধরে ডাকতে, উপস্থিত দর্শকের করতালির মধ্যে বেশ ধির গতিতেই মঞ্চে উঠে এলেন দৃঢ় চিত্ত সনমিত৷ চোখে একটাই স্বপ্ন: জীবন সংগ্রামে জিততে হলে ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'-র আসরে বাজিমাৎ যে তাঁকে করতেই হবে৷
হলোও তাই৷ একে একে এক লাখ, বিশ লাখ করে এক কোটি টাকা জিতে ফেললেন সনমিত৷ সামনে পাঁচ কোটি টাকার শেষ প্রশ্ন৷ এক কোটি টাকা নিশ্চিত হবার পর দুটো ‘লাইফ লাইন' ছিল সনমিতের৷ সে অবস্থায় ‘বিগ বি'-র মনে হয়েছিল, ঝুঁকি না নিয়ে সনমিতের খেলা ছেড়ে দেয়াই ভালো৷ তাতে ১ কোটি টাকা তো সে পাবেই৷ আর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারলে মাত্র এক লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে ফিরতে হবে মুম্বইয়ের এই গৃহিনীকে৷
পাঁচ কোটি টাকার প্রশ্নটি ছিল, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্বতশৃঙ্গ কে-২ প্রথমবারের মতো জয় করেছিলেন কোন নারী? উত্তরটি (ওয়ান্ডা রুটকিভিট্স) পাওয়ার পর উপস্থিত সকলের মতো স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন সনমিত৷ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন অমিতাভ বচ্চন৷ বলিউড মেগাস্টারের অভিব্যক্তি বলছে, ‘‘মেয়ে, তুমি হেরে গেছো!'' স্বামীর দেনা, সন্তানের লেখাপড়ার কী হবে! কিন্তু সনমিতের আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি পারবেন৷ পেরেছেনও৷ ভারতে কোনো রিয়ালিটি শো-তে তিনিই প্রথম নারী, যিনি এত বড় একটা অঙ্কের পুরস্কার জিতলেন৷
প্রশ্ন হলো, মাত্র ১২ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করা একটি মেয়ে কীভাবে জিতলেন এই পুরস্কার? কীভাবে দিলেন কঠিন কঠিন সব প্রশ্নের উত্তর, যা দিতে বহু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারকেও হোঁচট খেতে হয়? সনমিত জানান, ‘‘আসলে আমি বাচ্চাদের পড়াই৷ তাদের এবং আমার নিজের বাচ্চাদের পড়াতে পড়াতেই আমার জ্ঞান বাড়তে থাকে৷ এক জিনিস বারে বারে পড়ানোর ফলে আমার তা আত্মস্থও হয়ে যায়৷ তাছাড়া, বছর চারেক আগে আমার ইউট্রাসে একটা টিউমার হয়৷ তখন বিছানাতেই পড়ে থাকতে হতো আমাকে৷ সেসময় শুয়ে শুয়েই আমি নানা ধরণের বই পড়তে শুরু করি৷ এরপর প্রথম রাউন্ড ক্লিয়ার করার পর কেবিসি থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্য যখন ডাক আসে, তখন সেই দেড় মাসে আমি খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করি৷ ইন্টারনেট থেকে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন তথ্যও জোগাড় করে পড়ি৷''
সত্যিই গরিব ঘরের মেয়ে সনমিত৷ স্কুলের গণ্ডিতেই শেষ হয়েছিল লেখাপড়া৷ তারপরও সেই পুঁজি নিয়েই শুরু করেন বাচ্চাদের পড়াতে৷ কিন্তু পরবর্তী জীবনে কেন আর তাঁর পড়াশোনা হলো না? জিজ্ঞাসা করি কোটিপতি সনমিতকে৷ বলেন, ‘‘১৪ বছর বয়স পর্যন্ত আমি আমার দাদা-দাদির কাছে বড় হই৷ কিন্তু তারপর দাদুর ক্যান্সার ধরা পড়লে তাঁর জীবদ্দশায় আমার বিয়ে দেয়ার জন্য বাবা-মা মরিয়া হয়ে ওঠেন৷ কয়েক বছরের মধ্যেই আমার বিয়ে হয়ে যায়৷ তারপর আমি মুম্বই চলে আসি৷ তাই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনাও আর করা হয়ে ওঠে না৷''
৩৭ বছরের জীবনে স্বচ্ছলতা কী জিনিস না বুঝলেও, এখন আর কষ্ট করে ছাত্র না পড়ালেও চলবে তাঁর৷ ভারতীয় মুদ্রায় পাঁচ কোটি টাকা জিতেছেন তিনি৷ এটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! সনমিতের এ সাফল্যে অমিতাভ বচ্চনও খুব খুশি৷ সামাজিক যোগাযোগের সাইটে তিনি লিখেছেন, ‘ভারত ক'দিন আগে দেখলো ‘আমানত'-এর দুঃখজনক বিদায়, মেয়েটি চলে গেলেও রেখে গেছে আপোশ না করে, সাহস করে লড়াই করার চেতনা৷ আর সনমিত দেখালো যে সে-ও লড়তে জানে৷
এত যাঁর মনের জোর, কেমন নারী তিনি? সনমিত জানায়, ‘‘আমি ছোট থেকেই খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী৷ যদি একবার কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, তবে শেষ ঠিকমতো শেষ না করে ক্ষান্ত দেই না আমি, যে কোনো জিনিসের ক্ষেত্রেই...ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর সময়ও যদি কোনো বিষয় আমার পছন্দ হয়, তবে বিষয়টি সম্পর্কে, বিষয়টির সবগুলি দিক সম্পর্কে ওদের আমি জানাতে চাই৷ তার জন্য শত কষ্ট করতেও আমি রাজি৷''
লোকে বলে জীবনই আমাদের শেখায়৷ তা জীবন থেকে কী শিক্ষা পেয়েছেন তিনি? সনমিতের কথায়, ‘‘আমার টিউমারটা যখন ধরা পড়লো তখন শুয়ে থাকতে থাকতে মানসিক অবসাদে ভুগতাম আমি৷ কিছুই ভালো লাগতো না৷ সেসময় শুধুমাত্র আমার জন্য আমার স্বামী তাঁর চাকরি-বাকরি সব ছেড়ে দেন৷ আমার চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে তাঁর সামান্য যেটুকু সঞ্চয় ছিল, তা-ও শেষ হয়ে যায়৷ তারপরও তিনি আমাকে হাল ছাড়তে দেন নি৷ বরং বাচ্চাদের শুয়ে শুয়েই পড়ানোর উপদেশ দিতেন৷ বলতেন, তোমাকে একজন যোদ্ধা হতে হবে, ‘ফাইট' করতে হবে৷ ‘হিট মি টয়'-কে যেমন মারার পর সে পড়ে গিয়ে আবারো উঠে দাঁড়ায়, তেমনই আমার স্বামী বলতেন যে, এভাবেই তোমাকে আবার উঠে দাঁড়াতে হবে৷ তখনই আমি উপলব্ধি করি যে, জীবন সম্পর্কে পজিটিভ, ইতিবাচক দৃষ্টি রাখা কতটা জরুরি৷''