প্রধানমন্ত্রীকে ‘দায়ী' করা যায়, তবে..
১৭ জুলাই ২০১৫দেখতে দেখতে সাংবাদিকতায় ঊনিশ বছর কেটে গেল৷ জানি, সাংবাদিকতায় নিজের বয়স গুনছি দেখলে, যাঁদের কাছ থেকে অনেক শিখেছি তাঁদের কেউ কেউ হাসবেন৷ তা বয়স আর অভিজ্ঞতা তাঁদের তুলনায় না হয় কমই আমার, ফেলে আসা পথটা না হয় ছোট, তাই বলে এই ঊনিশ বছরে কী দেখেছি, কী শিখেছি ফিরে দেখে সেই হিসেব একটু মেলালে ক্ষতি কী!
এখন আমার ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে রমজান মাস আর ইফতার পার্টি৷ বাংলাদেশে রমজান যেমন সিয়াম সাধনার মাস, তেমনি ইফতার পার্টিরও মাস৷ রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং সামাজিক – তিন ধরনের ইফতার পার্টিরই ধুম পড়ে যায় সংযম পালনের এই মাসে৷ প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিরোধী দলীয় নেত্রী, এফবিসিসিআই, বাফুফে, বিসিবি, বিদেশি কূটনীতিক, প্রেস ক্লাব, হকার সমিতি, শ্রমিক লীগ, যুবদল, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ইসলামী ছাত্র শিবির, বাসমালিক সমিতি – কে না করে, কোথায় না হয় ইফতার পার্টি! এমনকি বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও ভাবনায় থাকে ইফতার৷ তাঁরা অবশ্য ইফতার পার্টি করেন না, গরিবদের মধ্যে ইফতার বিতরণ করেন৷
তো ইফতার এবং ইফতার পার্টি বাংলাদেশে শুধু ধর্মীয় ব্যাপার নয়৷ আমি যতদূর জানি, ধর্ম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে খুব কম ইফতার পার্টিতেই ধর্ম এবং ধর্ম বিষয়ক আলোচনা খুব বেশি গুরুত্ব পায়৷ আলোচনায় বরং আয়োজকের ভাবনা, স্বার্থ বা উদ্দেশ্যই গুরুত্ব পায়৷
প্রতি বছর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীকেও বিভিন্ন পেশার, নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে ইফতার করতে হয়৷ সেগুলোও ইফতার পার্টি৷ সাংবাদিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীর আনুষ্ঠানিক ইফতারে আমি কোনোদিন যাইনি৷ তবে এমন পার্টির খবর সাংবাদিকতার শিশুকাল থেকেই আমি অনুসরণ করে আসছি৷ চিরকাল দেখেছি, অন্য সব ইফতার পার্টির মতো এই ইফতার পার্টিতেও আয়োজক বা আমন্ত্রক প্রধানত আমন্ত্রিতদের সঙ্গে সম্পর্কটা একটু ঝালিয়ে নিতে চান৷ এখানে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের পর্বও থাকে৷ আসলে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বক্তব্যই থাকে সেই পর্বে৷ একটা বক্তব্য প্রায় আগের বছরের বক্তব্যের ‘কপি-পেস্ট'৷ প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী দলীয় নেত্রীর যত বিষয়ে যত মতবিরোধই থাকুক, সাংবাদিকদের কাছে দু-জনেরই মূল দাবি মোটামুটি এক – ‘বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করুন৷'
এই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতটা কী? যা সত্যি তা প্রচার করা? নাকি যা প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেত্রী কিংবা তাঁদের দলের জন্য সুবিধাজনক তা প্রচার করা? এর সরাসরি উত্তর অনেক সময়ই পাওয়া যায়নি৷ পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেউ সেটা বিশ্বাস করেননি৷ সাংবাদিকের কাজই হলো, অসংগতি, অন্যায়, অত্যাচার, অনিয়ম, অবিচারের খবর তুলে ধরা৷ তা তুলে ধরতে গিয়ে সাংবাদিক চোরের শত্রু – পুলিশেরও ‘শত্রু'৷ ‘চোর' যদি বলে, ‘আমি চাই চুরি করার সময় আমাকে ধরিয়ে দিন', কিংবা পুলিশকে যদি বলতে শোনা যায়, ‘ঘুস নিয়ে আমি যে চোরকে ছেড়ে দিলাম সেই খবরটা আপনি লিখে দিলে আমি অত্যন্ত খুশি হবো' – বিশ্বাস হবে কারো?
ইফতার পার্টিতে ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী বা অন্য ‘গণ্যমান্যরা' সাংবাদিকদের যে ‘বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এবং গঠনমূলক সমালোচনা'-র পরামর্শ দেন, সেটাকেও কোনোকালেই শুধু পরামর্শ মনে করা হয়নি৷ কোনো বিশেষ দলের কাছ থেকে সুবিধা না নেয়া সাংবাদিকরা সবসময়ই জানেন, হরতালের বিপক্ষে লিখলে সরকারি দল খুশি আর বিরোধী দল বেজার হবে৷ মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ, প্রশাসনে ঘুস-দুর্নীতির কথা লিখলে বিরোধী দল খুশি হবে আবার পেট্রোল বোমায় মা-শিশুকে পুড়িয়ে মারার খবর প্রচার করলে সেই বিরোধী দলই বলবে ‘সরকারের দালাল'৷ অথচ হরতালে দেশের ক্ষতি সত্য, গণতন্ত্রের মুক্তি দাবি করতে গিয়ে রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে নূর হোসেনের মৃত্যু সত্য, যুদ্ধাপরাধ বা একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সত্য, রাজাকার-আল বদর-আল শামস সত্য, ঘুস-দুর্নীতি সত্য, সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট, ধর্ষণ, জমি দখল সত্য, একতরফা গুলির ‘ক্রসফায়ার' সত্য, হামলা-মামলাও সত্য৷ তাহলে?
না তার মানে এই নয় যে, সাংবাদিকদের কোনো ‘ভুল' নেই৷ ছোট-বড় অনেক ঘটনাতেই ‘ভুল', ‘অদক্ষ' বা ‘অবিবেচনাপ্রসূত' সাংবাদিকতার নজির আমরা দেখেছি৷ দু-তিনটি ঘটনার সমালোচনা সাংবাদিকদের মুখেই শুনি৷ ‘বিডিআর বিদ্রোহের' সময় টেলিভিশনে সশস্ত্র বিডিআর সদস্যদের সাক্ষাৎকার বা ‘দম্ভোক্তি' প্রচার করা ঠিক হয়েছে কিনা – এ নিয়ে বিতর্ক হয়ত কোনোদিন থামবে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা এমন সাংবাদিকতাকে চিরকাল ‘নিষ্ঠুরতা' বা ‘অপরিনামদর্শিতা'-র দৃষ্টান্ত হিসেবেই মনে রাখবে৷
এবার ‘ছোট' একটি ঘটনার কথাও বলি৷ ২০১১ সালে ‘পারসোনা কেলেঙ্কারি'৷ ‘ভুল', ‘অদক্ষ' বা ‘অপরিণামদর্শী' সাংবাদিকতা যে কত ভয়াবহ তার দৃষ্ঠান্ত হতে পারে এটি৷ স্পা করাতে গিয়ে এক ভদ্রমহিলা আবিষ্কার করলেন গোপন ক্যামেরায় তাঁর নগ্ন দেহের ভিডিও করা হচ্ছে৷ প্রতিবাদ করলেন৷ স্বামীকে খবর দিলেন৷ স্বামী এসে অভিযুক্তদের সঙ্গে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে হাতাহাতিতেও জড়ালেন৷ পারসোনার দু'জন কর্মীকে চর-ঘুসি মারলেন৷ সব দেখানো হলো টেলিভিশনে৷ দেখানোর সময় ওই নারীর চেহারাটাই শুধু ঝাপসা করা হলো৷ বেশ কয়েকটি চ্যানেলে দেখানো হলো খবরটি৷ সাংবাদিকদের মনে ছিল, এ সব ক্ষেত্রে ‘ভিকটিম', অর্থাৎ ঘটনার যিনি শিকার তাঁর ছবি বা নাম প্রকাশ করা উচিত নয়৷ কিন্তু ভিডিওতে স্বামীর চেহারা দেখিয়ে দেয়ায় ওই নারীর পরিচয় কিন্তু পুরোপুরি গোপন থাকেনি৷ স্বাভাবিক কারণেই ভুক্তভোগী ‘বিচার’ পাননি৷ এক পর্যায়ে বিচার চাওয়াই হঠাৎ বন্ধ করে দিতে হয়েছিল৷ কিছু সাংবাদিকের ভুলে ভুক্তভোগী নারীর পরিচয় অন্যরা জেনে যাওয়ায় সেই নারীকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে তাঁর পরিবারই শেষ পর্যন্ত পারসোনার সঙ্গে আপোসরফা করেছিল – এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই৷ ভুলটা যে শুধু টেলিভিশন সাংবাদিকদেরই হয়েছে তা-ও নয়৷ এই মুহূর্তে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে সেই খবরটি দেখছি৷ সেখানে পারসোনার সমালোচনা আছে, গণমাধ্যমের একাংশের সমালোচনা আছে, সঙ্গে ওই নারীর স্বামীর নামটিও লেখা আছে স্পষ্ট করে৷
এমন সাংবাদিকতার সমালোচনা সাংবাদিকরাও করেন, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী তো করতেই পারেন৷ তাতে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ' হয়েছে বললে খুব একটা ধোপে টিকবে বলে মনে হয় না৷
সাংবাদিকতায় ঘাত-প্রতিঘাত, বাধা-বিপত্তি অনেক৷ বাংলাদেশে এর ভেতর দিয়েই সাংবাদিকতা এগোচ্ছে৷ ‘বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা'-র বিকল্প নেই৷ আবার বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ‘উপকৃতপক্ষ' ছাড়া খুব বেশি বন্ধুও নেই৷ একুশে টেলিভিশনের কথাই ভাবুন! এই চ্যানেলটির নাম যখন সবার মুখে মুখে ফিরতো, তখন বিএনপি ক্ষমতায়৷ ‘আইন লঙ্ঘন'-এর জুজু দেখিয়ে সম্প্রচার একেবারে বন্ধ করা হয়েছিল৷ ‘আরসল কারণ’ আইন লঙ্খন ছিল এটা কেউ বিশ্বাস করেনা, করবেওনা৷ একুশে টেলিভিশনের দ্বিতীয় জন্মের সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়৷ এবার চ্যানেলটির চেয়ারম্যান গেলেন জেলে৷ পর্নোগ্রাফি আইনে গ্রেপ্তার তিনি৷ এবারও ‘আইনের খাঁড়া'৷ তবে তারেক রহমানের ভাষণ লন্ডন থেকে সম্প্রচার করাই নাকি গ্রেপ্তারের আসল কারণ৷ কারণ যা-ই হোক, একুশে টেলিভিশন যেন এক জীবনে দু'বার জবাই হওয়া মুরগি৷ আগে ‘জবাই' করেছিল বিএনপি, এবার প্রায় জবাই করল আওয়ামী লীগ৷
শুরুটা রমজান মাস এবং ইফতার পার্টি দিয়ে করলেও ইফতার পার্টির মহিমা বর্ণনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়৷ বৃহস্পতিবার ‘সাংবাদিক সহায়তা ভাতা ও অনুদান প্রদান' অনুষ্ঠানে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা প্রত্যাশা করার পাশাপাশি অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
এটা কি ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য? প্রচ্ছন্ন হমকি? ‘সাংবাদিক সহায়তা ভাতা ও অনুদান প্রদান'-এ এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চললে৷ ইফতার পার্টিতে না হলেও কথাগুলো প্রধানমন্ত্রী রমজান মাসেই বলেছেন৷ তাই প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাংবাদিকদের সঙ্গে ইফতারের ফাঁকের সেই আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের কথা মনে পড়ল৷ আরেকটা প্রশ্নও উঁকি দিল মনে৷ এমন বক্তব্যের উদ্দেশ্য কি তা সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের কেউই কোনোদিন জানতে চান না কেন? সাংবাদিকদের দায়িত্ব তো শুধু সমালোচনা করা নয়, জানতে চাওয়াও...৷
ইফতার পার্টি বা এমন অনুষ্ঠানে গেলে সব সাংবাদিক কি সাংবাদিকতা ভুলে অনুগত শ্রোতা হয়ে যান? আর অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এলেই সমালোচক? এমন বক্তব্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা অবশ্যই করা যায়, তবে অবস্থা বুঝে নিরব শ্রোতা এবং অবস্থা বুঝে সমালোচক হওয়ার দায় সাংবাদিকদেরও আছে৷