প্রপাগান্ডা নয়, আয়োজনে সফল রাশিয়া
১৬ জুলাই ২০১৮সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন জারদের সাম্রাজ্য৷ তাঁদের বিপক্ষে সংগঠিত হচ্ছে বিপ্লবীরা৷ জারদের বিপক্ষে, বিপ্লবীদের পক্ষে অবস্থান নেন লেখক মাক্সিম গোর্কি৷ এজন্য কত বার গ্রেফতার হতে হয়েছে! কত রাত কাটাতে হয়েছে জেলে! এ সূত্রে আবার তাঁর বন্ধুত্ব তৈরি হয় রুশ বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সঙ্গে৷ ১৯১৭ সালের সফল রুশ বিপ্লবের পর জয়টা অন্য সবার মতো ছিল গোর্কিরও৷
অথচ দ্রুতই লেনিনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় তাঁর৷ জারদের পতনের পর যেভাবে রাষ্ট্র চলছিল, তা পছন্দ হয়নি এই লেখকের৷ লেখায়-কথায়, আড্ডা-আলোচনায় আবারও শুরু গোর্কির প্রবল সমালোচনা৷ সরকার তা মেনে নেবে কেন! তাই এক রকম স্বেচ্ছ্বা নির্বাসনে চলে যান এই লেখক৷ বসবাস করতে শুরু করেন জার্মানি এবং বেশিরভাগ সময় ইতালিতে৷ লেনিনের মৃত্যুর পর জোসেফ স্টালিন ক্ষমতা নেবার পরও দেশে ফেরেননি গোর্কি৷ অবশেষে ১৯৩২ সালে নিজ উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে ‘মা'-এর লেখককে দেশে ফিরিয়ে আনেন স্টালিন৷ ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির দেশ থেকে বিখ্যাত এই লেখকের প্রত্যাবর্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ছিল বিরাট এক প্রোগাগান্ডা জয়৷
২০১৮ বিশ্বকাপের আলোচনায় লেখক গোর্কির গল্প কেন? কারণ, এই বিশ্বকাপের আয়োজনকে ধরা হচ্ছিলো রুশ প্রোপাগান্ডা যন্ত্রের এক প্রজেক্ট৷ ইংল্যান্ডের মতো দেশকে টপকে যেভাবে রাশিয়া আয়োজক হয়েছে, তাতে গড়বড়ের সন্দেহ অনেকের৷ এই বিশ্বকাপ দিয়ে বাকি বিশ্বের কাছে রাশিয়ার ‘ইমেজ' পুণরুদ্ধারের চেষ্টা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন করছেন বলেও সংশয় অনেকের৷
কিন্তু বিশ্বকাপের সফল আয়োজন দিয়ে অন্যরকম ভাবতে বাধ্য করছে এখন রাশিয়া৷ সব শঙ্কা, সকল সংশয় উড়িয়ে দিয়েছে দেশটি৷ এটি যদি প্রোগাগান্ডা যন্ত্রের প্রজেক্টও হয়ে থাকে, তাহলে তা কী দারুণভাবেই না কাজ করেছে!
এসব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই ফুটবলপ্রেমীদের৷ বিশ্ব রাজনীতির ঘুঁটিখেলায় রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন ঘটল কিনা, তাতে তাঁদের কী যায়-আসে! সিরিয়া-ইউক্রেনের রক্তাক্ত সমস্যা উতরানোয় বিশ্বকাপ ফুটবলের রঙিন চশমা পরিয়ে দেয়া হয়েছে কিনা, তা নিয়েও ভাবনা নেই৷ পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরা চেয়েছিলেন নির্বিঘ্ন, নিরাপদ, নির্ঝঞ্চাট বিশ্বকাপ৷ সেই আয়োজনে রাশিয়া একশ'তে একশ'ই পাবে৷
বাকি বিশ্ব থেকে রাশিয়া বরাবর আলাদা৷ জার আমলে যেমন, সমাজতান্ত্রিক জমানায় তেমন, আবার হালফিলেও তাই৷ বিশ্বকাপ ফুটবল উপভোগ করতে আসা দর্শকদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা ছিল এটি৷ কিভাবে রুশরা গ্রহণ করবে তাঁদের! সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা এই আমার মনেও এই শঙ্কার চোরাস্রোত ছিল৷ টুর্নামেন্ট শুরুর চার দিন আগে এসেছি; প্রথম কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় এখানকার লোকদের একটু গুটিয়ে থাকতেই দেখেছি যেন৷ কিন্তু ১৪ জুন যেই না উদ্বোধনের রং ছড়ালো, রুশরা দু'হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাতে শুরু করে বাকি বিশ্বকে৷ এটি যে রুশদের জাতীয় মর্যাদার ব্যাপার!
বিশ্বকাপ কাভার করার জন্য ফিফা থেকে আমাদের দেওয়া হয়েছে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড৷ বাংলাদেশের রুশ দূতাবাসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে তা দিয়ে রাশিয়ার ভিসা পেতে সমস্যা হয়নি৷ গণমাধ্যম কর্মীদের তো তবু ভিসা নিতে হয়েছে; সমর্থকদের ওসবেরও বালাই নেই৷ ওয়েবসাইটে ঢুকে কেবল ‘ফ্যান আইডি' করলে সেটিই রাশিয়া প্রবেশের ভিসা৷ পুরো বিশ্বের জন্য এমন হাট করে দরজা খুলে রাখার উদাহরণ দেখিয়েছে আর কোনো দেশ?
বিশাল দেশ রাশিয়া৷ পৃথিবীর ছয় ভাগের একভাগ স্থল নিয়ে এর রাজসিক অবস্থান৷ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ১১ শহরে হচ্ছে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো৷ সবচেয়ে পশ্চিমের শহর কালিনিনগ্রাদ থেকে সবচেয়ে পুবের শহর ইয়েকাতেরিনবার্গের দূরত্ব মস্কো থেকে লন্ডনের দূরত্বের চেয়েও বেশি৷ ট্রেনে যেতে সময় লাগে ৩৬ ঘন্টা৷ এক ভেনু্ থেকে আরেক ভেনু্তে যাতায়াতে তাই ছিল বিস্তর হ্যাপার শঙ্কা! টিকেট পাওয়া যাবে কিনা, পেলেও দাম কত না জানি চড়বে! ফুটবল সমর্থকদের সে ভয়ও তাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন আয়োজকরা৷ ওই ‘ফ্যান আইডি' দিয়ে দিব্যি বিনা পয়সায় ট্রেনে এক শহর থেকে অন্য শহরে গিয়েছেন তাঁরা৷ চাট্টিখানি ব্যাপার নয় তা৷ আবার শহরের ভেতরেও বিনা মূল্যে যাতায়াতের পাস ফ্যান আইডি৷ সেটি অবশ্য কেবল ম্যাচের দিন নির্দিষ্ট শহরের জন্য৷ এতটাও কোন দেশ করেছে কবে!
নিরাপত্তা নিয়ে মনের ভেতর খচখচানি ছিল সমর্থকদের৷ আমারও৷ কিন্তু সেটি দূর হতেও সময় লাগেনি৷ মস্কোর লুজনিকি বা স্পার্তাক স্টেডিয়ামে কাজ শেষ করে মেট্রোতে করে নেমেছি ‘ভেদেনখা' স্টেশনে৷ প্রতি দিনই রাত ১০-১১ টা; কোনো কোনো দিন একটা-দুটো বেজে যায় পর্যন্ত৷ ততক্ষণে বাস-ট্রামের সংখ্যা কমে যায়; অপেক্ষা করতে হয় বেশ কিছুক্ষণ৷ সারা দিনের ধকলের পর কে করে তা! বাংলাদেশ থেকে আসা আমরা দুজন বা চারজন গণমাধ্যমকর্মী হোটেলের উদ্দেশ্যে শুরু করি মিনিট বিশেকের হাঁটা৷ সুনসান রাস্তায়; নির্জন পার্কের ভেতর দিয়ে৷ প্রথম প্রথম একটু যে গা ছমছম করতো না, তা নয়৷ কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে যেতে সময় লাগেনি৷ সেন্ট পিটার্সবার্গ, কাজান, সামারার মতো শহরগুলোয়ও কাজ শেষ করে অনেকবার ফিরেছি মধ্যরাতে৷ নিরাপত্তাহীনতা বোধ হয়নি কখনো৷ পৃথিবীর কোনো প্রান্ত থেকে আসা কোনো ফুটবল সমর্থকের কোনো সমস্যা হয়েছে বলেও শুনিনি৷ এটিও বিশ্বকাপ আয়োজনে রাশিয়ার বড় সাফল্য৷
বর্ণবাদ সমস্যায় ভুগছে রাশিয়া অনেককাল৷ ফুটবলও এর বাইরে নয়৷ এখানকার স্টেডিয়ামে কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদের উদ্দেশ্যে বানরের চিত্কার করার ঘটনা ঘটেছে; তাঁদের দিকে কলা ছুঁড়ে দেবার মতো দৃশ্যও দেখা গেছে আগে৷ আইভরি কোস্টের ফুটবলার ইয়া ইয়া তোরে তো এ কারণে কৃষ্ণাঙ্গরা ২০১৮ বিশ্বকাপ বয়কট করতে পারে বলেও হুশিয়ারি দিয়েছিলেন৷ বর্ণবাদের সেই কালো ছায়া কোনো স্টেডিয়ামের কোনো গ্যালারিতে দেখিনি৷ নিজেও অমন কিছুর মুখোমুখি হইনি৷ বিশ্বকাপের রংয়ে মিলে যায় তাবত্ মানুষের যাবতীয় চামড়ার রঙ৷ কালো-বাদামী-সাদার এক পোস্টার হয়ে থাকে তাই রাশিয়া বিশ্বকাপ৷
সমস্যা বলতে ছিল এক ভাষার সমস্যা৷ রয়েছে এখনো৷ বেশিরভাগ রুশ ইংরেজি বোঝেন না৷ তাই বলে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে গেছেন এমনটা ঘটেনি৷ পাশে থাকা ইংরেজি জানা কারো কাছে নিয়ে গেছেন হয়তো, নয়তো মোবাইল অ্যাপসে রুশ-ইংরেজির অনুবাদ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা৷ রুশদের এই আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ না জানিয়ে পারা যায় না৷ তাই তো এক মাসের বেশি সময়ে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটি উচ্চারণ করেছি, তা হলো ‘স্পাসিভা'৷ অর্থাত্ ধন্যবাদ৷
২০১৮ বিশ্বকাপের সফল আয়োজনের জন্য রাশিয়াকে বিশাল এক ধন্যবাদ৷ এটি যদি রুশ প্রোপাগান্ডা যন্ত্রের এক প্রজেক্ট হয়, তবুও! মাক্সিম গোর্কিকে নির্বাসন থেকে দেশে ফেরানোর জন্য যেমন ধন্যবাদ প্রাপ্য জোসেফ স্টালিনের; এমন বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ভ্লাদিমির পুটিনেরও সেটি প্রাপ্য৷ স্পাসিভা!
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷