1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রপাগান্ডা নয়, আয়োজনে সফল রাশিয়া

নোমান মোহাম্মদ
১৬ জুলাই ২০১৮

বিশ্বকাপ শুরুর আগে অনেক কথা হয়েছে রাশিয়া এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনকে নিয়ে৷ এক মাসেরও বেশি সময় রাশিয়ায় থেকে বিশ্বকাপ কাভার করে নোমান মোহাম্মদ মনে করছেন, বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ধন্যবাদই প্রাপ্য রাশিয়া এবং পুটিনের৷

https://p.dw.com/p/31UFf
ছবি: Reuters/

সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন জারদের সাম্রাজ্য৷ তাঁদের বিপক্ষে সংগঠিত হচ্ছে বিপ্লবীরা৷ জারদের বিপক্ষে, বিপ্লবীদের পক্ষে অবস্থান নেন লেখক মাক্সিম গোর্কি৷ এজন্য কত বার গ্রেফতার হতে হয়েছে! কত রাত কাটাতে হয়েছে জেলে! এ সূত্রে আবার তাঁর বন্ধুত্ব তৈরি হয় রুশ বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সঙ্গে৷ ১৯১৭ সালের সফল রুশ বিপ্লবের পর জয়টা অন্য সবার মতো ছিল গোর্কিরও৷

অথচ দ্রুতই লেনিনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় তাঁর৷ জারদের পতনের পর যেভাবে রাষ্ট্র চলছিল, তা পছন্দ হয়নি এই লেখকের৷ লেখায়-কথায়, আড্ডা-আলোচনায় আবারও শুরু গোর্কির প্রবল সমালোচনা৷ সরকার তা মেনে নেবে কেন! তাই এক রকম স্বেচ্ছ্বা নির্বাসনে চলে যান এই লেখক৷ বসবাস করতে শুরু করেন জার্মানি এবং বেশিরভাগ সময় ইতালিতে৷ লেনিনের মৃত্যুর পর জোসেফ স্টালিন ক্ষমতা নেবার পরও দেশে ফেরেননি গোর্কি৷ অবশেষে ১৯৩২ সালে নিজ উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে ‘মা'-এর লেখককে দেশে ফিরিয়ে আনেন স্টালিন৷ ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির দেশ থেকে বিখ্যাত এই লেখকের প্রত্যাবর্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ছিল বিরাট এক প্রোগাগান্ডা জয়৷ 

২০১৮ বিশ্বকাপের আলোচনায় লেখক গোর্কির গল্প কেন? কারণ, এই বিশ্বকাপের আয়োজনকে ধরা হচ্ছিলো রুশ প্রোপাগান্ডা যন্ত্রের এক প্রজেক্ট৷ ইংল্যান্ডের মতো দেশকে টপকে যেভাবে রাশিয়া আয়োজক হয়েছে, তাতে গড়বড়ের সন্দেহ অনেকের৷ এই বিশ্বকাপ দিয়ে বাকি বিশ্বের কাছে রাশিয়ার ‘ইমেজ' পুণরুদ্ধারের চেষ্টা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন করছেন বলেও সংশয় অনেকের৷

কিন্তু বিশ্বকাপের সফল আয়োজন দিয়ে অন্যরকম ভাবতে বাধ্য করছে এখন রাশিয়া৷ সব শঙ্কা, সকল সংশয় উড়িয়ে দিয়েছে দেশটি৷ এটি যদি প্রোগাগান্ডা যন্ত্রের প্রজেক্টও হয়ে থাকে, তাহলে তা কী দারুণভাবেই না কাজ করেছে!

এসব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই ফুটবলপ্রেমীদের৷ বিশ্ব রাজনীতির ঘুঁটিখেলায় রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন ঘটল কিনা, তাতে তাঁদের কী যায়-আসে! সিরিয়া-ইউক্রেনের রক্তাক্ত সমস্যা উতরানোয় বিশ্বকাপ ফুটবলের রঙিন চশমা পরিয়ে দেয়া হয়েছে কিনা, তা নিয়েও ভাবনা নেই৷ পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরা চেয়েছিলেন নির্বিঘ্ন, নিরাপদ, নির্ঝঞ্চাট বিশ্বকাপ৷ সেই আয়োজনে রাশিয়া একশ'তে একশ'ই পাবে৷

বাকি বিশ্ব থেকে রাশিয়া বরাবর আলাদা৷ জার আমলে যেমন, সমাজতান্ত্রিক জমানায় তেমন, আবার হালফিলেও তাই৷ বিশ্বকাপ ফুটবল উপভোগ করতে আসা দর্শকদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা ছিল এটি৷ কিভাবে রুশরা গ্রহণ করবে তাঁদের! সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা এই আমার মনেও এই শঙ্কার চোরাস্রোত ছিল৷ টুর্নামেন্ট শুরুর চার দিন আগে এসেছি; প্রথম কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় এখানকার লোকদের একটু গুটিয়ে থাকতেই দেখেছি যেন৷ কিন্তু ১৪ জুন যেই না উদ্বোধনের রং ছড়ালো, রুশরা দু'হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাতে শুরু করে বাকি বিশ্বকে৷ এটি যে রুশদের জাতীয় মর্যাদার ব্যাপার!

বিশ্বকাপ কাভার করার জন্য ফিফা থেকে আমাদের দেওয়া হয়েছে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড৷ বাংলাদেশের রুশ দূতাবাসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে তা দিয়ে রাশিয়ার ভিসা পেতে সমস্যা হয়নি৷ গণমাধ্যম কর্মীদের তো তবু ভিসা নিতে হয়েছে; সমর্থকদের ওসবেরও বালাই নেই৷ ওয়েবসাইটে ঢুকে কেবল ‘ফ্যান আইডি' করলে সেটিই রাশিয়া প্রবেশের ভিসা৷ পুরো বিশ্বের জন্য এমন হাট করে দরজা খুলে রাখার উদাহরণ দেখিয়েছে আর কোনো দেশ?

রাশিয়ায় গিয়ে বিপদে নাইজেরীয়রা

বিশাল দেশ রাশিয়া৷ পৃথিবীর ছয় ভাগের একভাগ স্থল নিয়ে এর রাজসিক অবস্থান৷ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ১১ শহরে হচ্ছে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো৷ সবচেয়ে পশ্চিমের শহর কালিনিনগ্রাদ থেকে সবচেয়ে পুবের শহর ইয়েকাতেরিনবার্গের দূরত্ব মস্কো থেকে লন্ডনের দূরত্বের চেয়েও বেশি৷ ট্রেনে যেতে সময় লাগে ৩৬ ঘন্টা৷ এক ভেনু্ থেকে আরেক ভেনু্তে যাতায়াতে তাই ছিল বিস্তর হ্যাপার শঙ্কা! টিকেট পাওয়া যাবে কিনা, পেলেও দাম কত না জানি চড়বে! ফুটবল সমর্থকদের সে ভয়ও তাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন আয়োজকরা৷ ওই ‘ফ্যান আইডি' দিয়ে দিব্যি বিনা পয়সায় ট্রেনে এক শহর থেকে অন্য শহরে গিয়েছেন তাঁরা৷ চাট্টিখানি ব্যাপার নয় তা৷ আবার শহরের ভেতরেও বিনা মূল্যে যাতায়াতের পাস ফ্যান আইডি৷ সেটি অবশ্য কেবল ম্যাচের দিন নির্দিষ্ট শহরের জন্য৷ এতটাও কোন দেশ করেছে কবে! 

নিরাপত্তা নিয়ে মনের ভেতর খচখচানি ছিল সমর্থকদের৷ আমারও৷ কিন্তু সেটি দূর হতেও সময় লাগেনি৷ মস্কোর লুজনিকি বা স্পার্তাক স্টেডিয়ামে কাজ শেষ করে মেট্রোতে করে নেমেছি ‘ভেদেনখা' স্টেশনে৷ প্রতি দিনই রাত ১০-১১ টা; কোনো কোনো দিন একটা-দুটো বেজে যায় পর্যন্ত৷ ততক্ষণে বাস-ট্রামের সংখ্যা কমে যায়; অপেক্ষা করতে হয় বেশ কিছুক্ষণ৷ সারা দিনের ধকলের পর কে করে তা! বাংলাদেশ থেকে আসা আমরা দুজন বা চারজন গণমাধ্যমকর্মী হোটেলের উদ্দেশ্যে শুরু করি মিনিট বিশেকের হাঁটা৷ সুনসান রাস্তায়; নির্জন পার্কের ভেতর দিয়ে৷ প্রথম প্রথম একটু যে গা ছমছম করতো না, তা নয়৷ কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে যেতে সময় লাগেনি৷ সেন্ট পিটার্সবার্গ, কাজান, সামারার মতো শহরগুলোয়ও কাজ শেষ করে অনেকবার ফিরেছি মধ্যরাতে৷ নিরাপত্তাহীনতা বোধ হয়নি কখনো৷ পৃথিবীর কোনো প্রান্ত থেকে আসা কোনো ফুটবল সমর্থকের কোনো সমস্যা হয়েছে বলেও শুনিনি৷ এটিও বিশ্বকাপ আয়োজনে রাশিয়ার বড় সাফল্য৷ 

Noman Mohammad
নোমান মোহাম্মদ, ক্রীড়া সাংবাদিকছবি: privat

বর্ণবাদ সমস্যায় ভুগছে রাশিয়া অনেককাল৷ ফুটবলও এর বাইরে নয়৷ এখানকার স্টেডিয়ামে কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদের উদ্দেশ্যে বানরের চিত্‍কার করার ঘটনা ঘটেছে; তাঁদের দিকে কলা ছুঁড়ে দেবার মতো দৃশ্যও দেখা গেছে আগে৷ আইভরি কোস্টের ফুটবলার ইয়া ইয়া তোরে তো এ কারণে কৃষ্ণাঙ্গরা ২০১৮ বিশ্বকাপ বয়কট করতে পারে বলেও হুশিয়ারি দিয়েছিলেন৷ বর্ণবাদের সেই কালো ছায়া কোনো স্টেডিয়ামের কোনো গ্যালারিতে দেখিনি৷ নিজেও অমন কিছুর মুখোমুখি হইনি৷ বিশ্বকাপের রংয়ে মিলে যায় তাবত্‍ মানুষের যাবতীয় চামড়ার রঙ৷ কালো-বাদামী-সাদার এক পোস্টার হয়ে থাকে তাই রাশিয়া বিশ্বকাপ৷

সমস্যা বলতে ছিল এক ভাষার সমস্যা৷ রয়েছে এখনো৷ বেশিরভাগ রুশ ইংরেজি বোঝেন না৷ তাই বলে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে গেছেন এমনটা ঘটেনি৷ পাশে থাকা ইংরেজি জানা কারো কাছে নিয়ে গেছেন হয়তো, নয়তো মোবাইল অ্যাপসে রুশ-ইংরেজির অনুবাদ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা৷ রুশদের এই আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ না জানিয়ে পারা যায় না৷ তাই তো এক মাসের বেশি সময়ে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটি উচ্চারণ করেছি, তা হলো ‘স্পাসিভা'৷ অর্থাত্‍ ধন্যবাদ৷

২০১৮ বিশ্বকাপের সফল আয়োজনের জন্য রাশিয়াকে বিশাল এক ধন্যবাদ৷ এটি যদি রুশ প্রোপাগান্ডা যন্ত্রের এক প্রজেক্ট হয়, তবুও! মাক্সিম গোর্কিকে নির্বাসন থেকে দেশে ফেরানোর জন্য যেমন ধন্যবাদ প্রাপ্য জোসেফ স্টালিনের; এমন বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ভ্লাদিমির পুটিনেরও সেটি প্রাপ্য৷ স্পাসিভা!

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷