প্রবাসী বেওয়ারিশ লাশের গল্প
৭ এপ্রিল ২০১৮প্রবাস থেকে লাশ ফেরা নিয়ে জটিলতা এবং ভুল ঠিকানায় পৌঁছানোর পর সেই লাশ নিয়ে ভোগান্তির উপর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘অজ্ঞাতনামা' ২০১৬ সালে বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে৷
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যা নিয়ে তৈরি তৌকির আহমেদ পরিচালিত এ চলচ্চিত্রটি একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা যেতে পারে৷ কেননা প্রবাসীদের গল্প নিয়ে এ ধরনের ছবি বাংলাদেশে অন্তত কেউ নির্মাণ করেননি৷
প্রবাস থেকে লাশ আসা নিয়ে ভোগান্তি দীর্ঘদিনের৷ তৌকির পরিচালিত সিনেমাটি এ সব বিষয় পুরোপুরি আসেনি৷ সিনেমার জন্য এর পুরোটা আনার প্রয়োজনও নেই৷ তবে যা এসেছে, তাতে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সাধারণ দুর্দশা ও তাদের পরিবারের অসহায়ত্ব ভালোভাবেই ফুটে ওঠে৷
প্রবাসীদের একটি বড় অংশের দীর্ঘদিনের দাবি হচ্ছে, প্রবাসে মৃতদের লাশ রাষ্ট্রীয় খরচে এবং ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে পাঠানো৷ প্রায়ই খবর পাওয়া যায়, অমুক দেশে তমুক বাংলাদেশির লাশ বেওয়ারিশ হয়ে পরে আছে৷ বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী শ্রমজীবীদের জন্য এটা একটা সাধারণ ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে৷
বাংলাদেশের বহুল পঠিত অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রবাস পাতার দায়িত্বে থাকার সময় প্রায়ই এ ধরনের সংবাদ ছাড়তে হতো৷ অনেকক্ষেত্রেই লাশ সনাক্ত করার মতো কাউকে পাওয়া যায় না৷
‘অজ্ঞাতনামা' চলচ্চিত্রের গল্পের মতোই একটি খবর প্রকাশ পায় একসময়৷ অজ্ঞাতনামা এক সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশির লাশ সেবার ভুল করে পাকিস্তানে পাঠানো হয়৷ আসলে নামবিভ্রাটের কারণে ওই ঘটনাটি ঘটেছিল৷ পরে পাকিস্তান থেকে ওই লাশ আবারো ফেরত পাঠানো হয়েছিল সৌদি আরবে৷ তবে সেই বাংলাদেশির লাশ শেষ পর্যন্ত ফেরত এসেছিল কিনা জানা নেই!
আরেকবার ছাপাতে হয়েছিল, আরব আমিরাতের একটি হাসপাতালে তিনমাস বেওয়ারিশ হয়ে পরে থাকা এক বাংলাদেশির লাশের খবর৷ সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভাইরাল হলে ঐ ব্যক্তির পরিবার জানতে পারে তার মৃত্যুর খবর৷
দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ নানা দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিরা সরকারি ব্যবস্থাপনা ও খরচে লাশ দেশে নিয়ে আসার ব্যাপারে দাবি জানিয়ে আসলেও সেটা আমলে নেয়নি বাংলাদেশ সরকার৷
এমন অনেকক্ষেত্রেই হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিজেরাই চাঁদা বা তহবিল তুলে প্রবাসে মৃত ব্যক্তির লাশ দেশে তার সামর্থ্যহীন পরিবারের কাছে ফেরত পাঠিয়েছেন৷
২০১৭ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ২৫ বছর বয়সি এক বাংলাদেশি ছাত্রের মৃত্যুর পর এ রকম তহবিল তোলার ঘটনার কথা মনে পরে৷ মোহাম্মদ কিবরিয়া নামের ওই ছেলেটির মা ছাড়া কেউ ছিল না৷ বাবা মারা যাওয়ায় প্রবাসে শিক্ষার খরচ জোগাতেই সে হিমশিম খাচ্ছিল৷ তার অকাল এবং হঠাৎ মৃত্যুর পর প্রবাসী বাংলাদেশিরা সরকারি খরচে লাশ দেশে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসের সাহায্য চান৷
কিন্তু মৃত কিবরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের ‘ওয়েজ আরনার্স বোর্ডে'-র সদস্য না হওয়ায় তার লাশ সরকারের টাকায় বহন করার ‘কোনো সুযোগ' ছিল না বলে দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়৷ পরে সিডনি প্রবাসীরা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর শাহরিয়ার আলমের সাথে ই-মেলে যোগাযোগ করলে তিনিও দুঃখ প্রকাশ করে একই কথা লিখেন৷
সবশেষ প্রবাসীরা নিজেরাই ফেইসবুক ও অন্যান্য মারফতে ক্যাম্পেইন চালিয়ে কিবরিয়ার লাশ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন৷
জীবিকার তাগিদে সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য এমনকি ইউরোপেরও নানা দেশে অবৈধভাবে প্রচুর বাংলাদেশি যান৷ এদের অনেকেই ‘ওয়েজ আর্নার্স বোর্ডে'-র সদস্য নন৷
তবে তাঁদের অধিকাংশই কিন্তু রেমিটেন্স যোদ্ধা৷ অথচ বিদেশ বিভুঁইয়ে তাঁদের কারও কারও নিঃস্ব অবস্থায় মৃত্যু হলে, অনেকসময়ই অযত্নে বেওয়ারিশ হিসেবে কিংবা ‘অজ্ঞাতনামা' হিসেবে ভিনদেশের মাটিতেই কবর দেওয়া হয়৷
তৌকির পরিচালিত ‘অজ্ঞাতনামা' এ সব প্রবাসীর কথা মনে করিয়ে দেয়৷ নিছক সিনেমায় বলা গল্পের বাইরেও যেন অনেক গল্প এক লহমায় বলে ফেলে৷
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কারটা তাই অপাত্রে যায়নি বলাই যায়!
ব্লগ পোস্টটি কেমন লাগলো? লিখুন আমাদের, নীচের ঘরে৷