প্রবাসীদের জন্য ‘আউট অফ দ্য বক্স’ পরিকল্পনা
১৪ মে ২০১৮সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশিদের জন্য পযর্টন বাদে অন্যসব ক্ষেত্রে ভিসা নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর৷ আমিরাত সরকার বলেছিল, বাংলাদেশিরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বেশি জড়িয়ে পড়ায় তারা আর লোক নিতে ইচ্ছুক নয়৷ ফলে সেখানকার বৈধদের তো বটেই, খেটেখাওয়া সাধারণ বাঙালিদের বড় দুর্দিন গেছে৷ ২০১২ সালের আগস্টের সেই জট মাত্র কিছুদিন আগে ছাড়ল৷ তবু পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি আমিরাত সরকার৷
মধ্যবর্তী সময়ে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকই সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন৷ অনেকে দেশে ফিরে আসলে কীভাবে ঋণ করে বিদেশ যাওয়ার টাকা শোধ করবেন, সে চিন্তা থেকে অবৈধ হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন৷ আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার ছিল৷ সেখানে সরকারি হিসেবে ১২ লাখ বাংলাদেশি ছিল৷ এদের মধ্যে হয়ত সামান্য ক'জন অপরাধী!
দেশ থেকে যখন বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করা হয়, তখন এসব অপরাধীরা কোন ফাঁকফোকর দিয়ে পালিয়ে যায়, সে কথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিশ্চয়ই জানা থাকে৷
বেশিরভাগ সময় বিদেশি দূতাবাসের কাছে অবৈধভাবে যাওয়া বাংলাদেশিদের ব্যাপারে কোনো তথ্যই থাকে না৷ আমিরাতের বাংলাদেশি দূতাবাসে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তারাও এ তথ্য দিতে পারবেন না৷ বাস্তব হচ্ছে, আমিরাতে হয়ত ২০ লাখ বাংলাদেশি থাকেন, ১২ লাখের কথা দূতাবাস জানে৷ আর বাকি ৮ লাখ কে বা কারা তা দূতাবাস জানেই না! কিন্তু অপরাধের সাথে যুক্ত ঔ বাঙালিরা যখন বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ধরা পড়েন, তখন দেশেরই বদনাম হয়৷
ধরলাম আমাদের লোকবল নেই৷ কূটনৈতিক তৎপরতায় আমরা ততটা পারদর্শীও না৷ এটা হতে পারে৷ কিন্তু সরকারের উদ্যোগে যাওয়া সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের উপর যখন নির্যাতন হয়, তখনও কী রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু করার থাকে না?
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়৷ আজ পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে কখনো দেখিনি, নির্যাতনের ব্যাপারে প্রতিবাদ তো দূরে থাক, সামান্য কোনো দেন-দরবার করতে৷
বেশ কয়েক বছর আগে একটি ঘটনা খুব নাড়া দিয়েছিল৷ সেটা হলো – সৌদি আরবে সাত বাংলাদেশির শিরশ্ছেদের ঘটনা৷
শিরশ্ছেদ হওয়ার পরে বাংলাদেশে খবর হয়েছিল৷ অথচ দীর্ঘদিন ধরে বিচার চলার সময় দূতাবাস বা অন্য কোনো জায়গা থেকে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আলোচনা শোনা যায়নি৷ এত বড় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, অথচ দূতাবাস জানলো না? আত্মপক্ষ সমর্থনের অনেক তরিকা যে কেউ বাতলাতেই পারে, কিন্তু দায় এড়ানো কি যায়?
ঐসময় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বাংলাদেশিদের একজন নাকি বলেছিল, বিচার প্রক্রিয়া চলার সময় তারা বিচারকের ভাষাই বুঝতে পারেনি!
থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সীমান্তে আবিষ্কার হয়েছিল অভিবাসীদের গণকবর৷ সেখান থেকে এক বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল৷ বাকি গণকবর থেকে কোনো বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার হয়েছে কিনা, জানা নেই৷ খুব অদ্ভুত হলেও সত্যি এ ঘটনার পর ওসব লাশের মধ্যে বাংলাদেশিদের কেউ আছেন কিনা তা খুঁজে বের করার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগ প্রকাশ বা উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারটা দৃশ্যমান হয়নি৷
প্রায়ই বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের মৃত্যুর খবর আসে৷ টাকা-পয়সা কম বা পারিবারিকভাবে অস্বচ্ছল হওয়ায় অনেকেই রাষ্ট্রীয় খরচে লাশ দেশে আনার দাবি তোলেন৷ তবে সে দাবি কখনো সরকারের কান পর্যন্ত যায় কিনা কে জানে৷ কিছুদিন আগে মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের এক সামিটে, প্রবাসী নেতারাও একই কথা বলেছেন, কোনও কূল কিনারা এখনো হয়নি৷
যতদূর জানা যায়, ইউরোপের দেশগুলোতে অবস্থানরত অস্বচ্ছল বাঙালিদের লাশ দেশে নিয়ে যাওয়ার খরচ সরকার কিছুটা বহন করে৷ এক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের নিতান্ত শ্রমজীবীরা৷ অনেক সময়ই এরকম সংবাদও চোখে পড়ে - বিদেশের মাটিতে কোনও বাংলাদেশি মারা যাওয়ার পর, তার লাশ শনাক্ত হয়েছে কয়েকমাস পরে৷ প্রবাসী এক বাঙালির মৃত্যুর খবর শুনে দূতাবাসেরও কারও শনাক্ত করার সময় হয়নি আসলে৷
রেমিটেন্স আর্নারস হিসেবে প্রবাসীদের আমরা সমবসময়ই মুখে মুখে প্রশংসা করে ফেনা তুলে দেই৷ কিন্তু দেশে-বিদেশে কোথাও তাদের জন্য বিশেষ কোনও সুবিধা নেই৷ প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বেশিরভাগ এখনো হুন্ডি করেই টাকা পাঠাতে পছন্দ করেন, সেটাই তাদের সুবিধা৷ তাদেরকে বৈধ উপায়ে টাকা পাঠানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা একেবারে অপ্রতুল, অনাকর্ষণীয়৷
বিদেশের কারাগারে পুলিশে ধরলে, বা অন্যকোনও বিপদে পড়লে বাংলাদেশিদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এখন পর্যন্ত চোখে পড়ে না৷ দীর্ঘকাল প্রবাসে থাকার পর দেশে ফিরলে বিমানবন্দরের দুর্ব্যবহারেই বেশিরভাগ প্রবাসীর মন বিষিয়ে যাওয়ার অভিযোগ এসেছে বারবার৷
সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীদের এ সব অভিযোগগুলোর অনেকগুলোই কেবল সদিচ্ছা আর পরিকল্পনা দিয়ে পূরণ করা যায়৷ পররাষ্ট্র আর প্রবাস কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগেই তা করা উচিত৷ অবশ্য তা কবে হবে কে জানে! কেননা আজ পর্যন্ত প্রবাসীদের সুখ-দুঃখের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এই দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে কোনও মিটিং-সিটিংয়ের খবর তো চোখে পড়েনি৷
প্রবাসে একজন বাংলাদেশির পাশে আরেকজন বাংলাদেশিই এগিয়ে আসেন৷ সেক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে এলাকা ভাগ করে দিয়ে, একজন কমিউনিটি নেতা নির্বাচন করে তাকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বাকিদের দেখভালের কিছুটা দায়িত্ব পালনের পদক্ষেপ কিন্তু দূতাবাস হাতে নিতে পারে৷
একটি নিয়মিত প্রবাসের টুকিটাকি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট তৈরি করা কি খুব কঠিন? একটি অ্যাপ তৈরি করা, যেখানে বিদেশের মাটিতে কাছাকাছি থাকা সমস্ত বাংলাদেশির রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক হবে এবং কেউ বিপদে পড়লে সেখানে জানানো মাত্র কাছাকাছি থাকা অন্য কেউ পরামর্শ দিবেন বা সাহায্যে এগিয়ে আসবেন!আমার মনে হয়, প্রবাসীদের কল্যাণে সরকারের ‘আউট অফ দ্য বক্স' চিন্তার সময় এসেছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷