1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ

ড. এ এস এম আতীকুর রহমান
১০ অক্টোবর ২০১৭

দেশের অনেক প্রবীণ যেমন অবসরকালীন ভাতা এবং অনেক দরিদ্র প্রবীণ বয়স্কভাতা পেলেও প্রবীণদের জন্য এখনো অনেক কিছু করার আছে৷ এখনো তো কয়েক লাখ প্রবীণকে জীবন ধারণ করতে হয় ভিক্ষা করে!

https://p.dw.com/p/2lQ32
Bangladesch alte Menschen
ছবি: DW/M. M. Rahman

১. কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরঞ্চ সকলকে নিয়ে বিশ্বসমাজের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির অভিযাত্রা চলমান রাখতে হবে৷ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা দলিলের মাহাত্ম্যই এখানে৷ বয়সের বিবেচনায়, আমাদের সমাজগুলো প্রধানত তরুণ-যুব-কর্মক্ষম জন-অংশের অনুকূলেই থাকে৷ তারুণ্য আর যুবশক্তির জয়গান গাওয়াই যেন সমাজের রীতি৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বসংসারের সকল সুবিধা এবং আয়োজন কেবল এদেরকেই ঘিরে৷ শিশু সুরক্ষার বিষয়টি নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলেও প্রবীণদের (৬০ বছর বা তদূর্ধ বছর বয়সি) কথা সমাজের কেউ যেন মুখেই আনতে চান না৷ এ পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশে তো বটেই৷ কিন্তু প্রবীণ জনসংখ্যা সবখানে হুহু করে বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে অতি প্রবীণরা (৮০+ বছর বয়সি)৷

২. বিশ্বজুড়ে ১৯৯০ সালের ৫০ কোটি প্রবীণ-জনসংখ্যা বেড়ে ২০১৫ সালে হলো ৯০ কোটি, যা ২০৩০ সালে গিয়ে হবে ১৪০ কোটি আর ২০৫০ সাল নাগাদ ২০৯ কোটি! পাশাপাশি, বাংলাদেশে বর্তমানে বাস করছেন প্রায় ১.৪০ কোটি প্রবীণ৷ ২০২৫, ২০৫০ এবং ২০৬১ সালে এঁদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে প্রায় দুই কোটি, সাড়ে চার কোটি এবং সাড়ে পাঁচ কোটিতে! ২০৫০ সালে বাংলাদেশের শিশু এবং প্রবীণের অনুপাত হবে মোট জনসংখ্যার ১৯:২১ শতাংশ! ১৯২১ সালে এ দেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল যেখানে ছিল মাত্র ২০ বছর; বর্তমানে তা ৭১ ছাড়িয়েছে! জাতিসংঘের কথায়, জীবনের সাথে আমরা অতিরিক্ত বছর যোগ করতে পেরেছি কিন্তু বাড়তি বছরগুলোতে জীবন যোগ করতে পারিনি! তবে বিজ্ঞানীরা বার্ধক্য জয়ের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন; আর আমরাও আশাবাদী৷ 

৩. সংখ্যায় বাংলাদেশের প্রবীণরা কেবল দ্রুত বাড়ছেন, তাই নয়; এঁদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর মতো পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সক্ষমতা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে৷ বার্ধক্য আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য আজ একটি  মারাত্মক চ্যালেঞ্জ৷ এক্ষেত্রে যে অবস্থাটি বেশি উদ্বেগজনক, তা হলো দ্রুত বর্ধমান বার্ধক্যের ধাক্কা মোকাবেলায় ন্যূনতম চিন্তা-ভাবনা, প্রস্তুতি এবং বন্দোবস্ত আমাদের জনগণের ব্যক্তি, দম্পতি বা পরিবার পর্যায়ে প্রায় নেই বললে অত্যুক্তি হবে না৷ বার্ধক্য বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমরা একান্তই রি-অ্যাক্টিভ; কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই প্রো-অ্যাক্টিভ হতে হবে৷ দেশে একটা প্রবাদ আছে, সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়!

৪. বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক নাগরিক নানা ধরনের প্রতিবন্ধিতা, অটিজমে আক্রান্ত এবং সমাজ বিচ্ছিন্ন৷ আমাদের সাধারণের ধারণা যে, প্রতিবন্ধিতা এবং অটিজম সম্ভবত শিশুদের ব্যাপার৷ বাস্তবতা হলো, এ ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ব্যক্তিবর্গ একসময় প্রবীণ হবেন৷ আবার, বার্ধক্যে পৌঁছে অনেকেই বিভিন্ন প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত হন৷ প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিবন্ধী প্রবীণদের জন্যে আমরা কি ন্যূনতম কোনো কর্মসূচি গ্রহণের কথা ভেবেছ? ভাবিনি৷ এটি আমাদের এক ধরনের বয়স বৈষম্যজনিত গাফিলতি৷ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, প্রবীণ পুরুষের তুলানায় প্রবীণ নারীরা বেশিদিন বাঁচেন৷ অধিকাংশই আবার বিধবা হয়ে! আমাদের সমাজে তাঁরা বেশি মাত্রায় অবহেলা, দুর্ব্যবহার এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ এমনকি নিজের ভাই, স্বামী, সন্তানদের কাছ থেকেই! অসহায় প্রবীণার হৃদয়ে এমন অবস্থায় নীরবে ভেসে আসে, ‘‘যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি, আর এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি!''

৫. বৃদ্ধাশ্রম এবং প্রবীণনিবাস সম্পর্কে সমাজে আমাদের খানিকটা ভুল ধারণা আছে৷ এতিমখানা এবং হোস্টেল যেমন এক কথা নয়, তেমনি বৃদ্ধাশ্রম এবং প্রবীণনিবাসও একই পর্যায়ের নয়৷ হল-হোস্টেলে থেকেই আমরা সগর্বে লেখাপড়া করেছি৷ বাসাবাড়ির বাইরে লেখাপড়ার জন্যে এটি ছাত্রছাত্রীদের জন্য যেমন একটি ভালো বিকল্প, প্রবীণদের কাছে প্রবীণনিবাসও ঠিক তেমনি একটি স্বাধীন বিকল্প! হল-হোস্টেলে থাকার সময় আমরা যেমন মা-বাবা ও নিজ পরিবারকে মিস করতাম, প্রবীণ নিবাসীরাও একইভাবে তাঁদের পরিবারের আবহ এবং সন্তানদের মিস করেন৷ ঐতিহাসিক তথ্য হলো, এদেশে কখনোই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যগত বৃদ্ধাশ্রম গড়ে ওঠেনি এবং এখনও নেই৷ এক কোটি চল্লিশ লাখ প্রবীণের জন্য বর্তমানে এদেশের হাতেগোনা ৪/৫ টি প্রবীণ নিবাসে সাকুল্যে আবাসন আছে খুব বেশি হলে মাত্র ২০০০ প্রবীণ-প্রবীণার!

৬. শেষ বয়েসের দেখভালে আমরা সন্তানের আবেগপূর্ণ মমতা আর পারিবারিক সেবাযত্ন আশা করে চলেছি৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পরিবার পরিকল্পনার কল্যাণে বর্তমানে আমাদের সন্তানসন্ততির সংখ্যা ১/২ -এ নেমে এসেছে৷ পাশাপাশি, বিশ্বময় অভিভাসন, নারীশিক্ষা ও কর্মসংস্থান ইত্যাদির সুযোগ অবারিত হবার কারণে সন্তানরা এখন মাতাপিতাকে একাকী রেখে দূরে, বহু দূরে চলে যাচ্ছে৷ আবার, স্বচ্ছল প্রবীণ বা বয়োবৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রী'র পক্ষে স্বতন্ত্র বাড়িতে একাকী বসবাস করার মতো আয়োজন, নিরাপত্তা ও প্রচলন আমাদের দেশ-সমাজ-সংস্কৃতিতে এখনও গড়ে ওঠেনি স্বস্তিময় বার্ধক্যের লক্ষে প্রতিজন প্রবীণের প্রয়োজন পেশাদারী চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা, উপযোগী খাদ্য, ওষুধ, পথ্য, শয্যা, বিনোদন, নিরাপত্তা, সমবয়সিদের সরব উপস্থিতি এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা৷ কিন্তু আজকের বাংলাদেশে উপযুক্ত সবকিছু নিজ বাড়িতে বসে পাওয়া খুবই কঠিন৷ কারণ, নিজেদের বাসা-বাড়িতে প্রবীণ পিতামাতার দেখভালের জন্যে সন্তানসন্ততির সংখ্যা বা উপস্থিতি খুবই কম, সেবাদানকারী মানুষ জোগাড় করাও দুরূহ আর পেশাদার ডাক্তার-নার্স পাওয়া প্রায় অসম্ভব৷ বিশেষ করে নারী, সংসারহীন, সন্তানহীন, একা, কেবল কণ্যাসন্তানধারী, গ্রামীণ ও হতদরিদ্র প্রবীণদের নিরাপদ বসবাস এবং মৌলিক চাহিদার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া দরকার৷ 

স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবীণ নিবাস হচ্ছে সবচেয়ে ভালো বিকল্প, যেখানে প্রতিজন প্রবীণ ব্যক্তির খাদ্য ও পুষ্টি, পেশাগত চিকিৎসা-পরিচর্যা, সাহচর্য, বিনোদন, সামাজিক যোগাযোগ ইত্যাদি হাতের নাগালে থাকে৷ বিশেষকরে অতি বার্ধক্য মুহুর্তে (৮০ বছরের ওপরে, মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতায় বা চরমভাবে বিছানায় পড়ে গেলে) দরকারি চাহিদা পূরণের ন্যূনতম নিশ্চয়তার ব্যবস্থা থাকে৷ কেবলমাত্র ভাববাদী, আবেগনির্ভর বা লোক দেখানোর জন্যে নয়, বরঞ্চ বিচক্ষণ ও দূরদর্শী হয়ে সন্তানসন্তুতি ও নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত পরিবারে বসবাসের সুযোগের পাশাপাশি আমাদের দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রবীণনিবাস ও প্রবীণ সেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা এখন থেকেই ভাতে হবে৷

৭. আশার কথা, বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সরকার মোটামুটি প্রবীণবান্ধব৷ বিশেষ করে দেশের বিরাট আকারের প্রবীণদের বাস্তব কল্যান বিধানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ উদ্যোগ, সাফল্য এবং সুনাম প্রশংসনীয়৷ এদেশে ১৯২৫ সালে বৃটিশ সরকার প্রবর্তিত অবসরকালীন পেনশন ব্যবস্থার পর ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে যুগান্তকারি বয়স্কভাতা কর্মসূচি প্রচলন, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ ও পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন, কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯/৬০ করা, পেনশন সুবিধা সম্প্রসারণ, পিতামাতাকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবারের সদস্য ৪ হতে ৬ জনে উন্নীতকরণ, বাংলাদেশ প্রবীণহিতৈষী সংঘের প্রবীণ-স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনুদান বৃদ্ধি করাসহ প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠনের উদ্যোগ প্রবীণদের সুরক্ষায় সরকারের  দায়বদ্ধতার প্রত্যক্ষ উদাহরণ৷ তবে ‘লিড মন্ত্রণালয়' হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন যাবত প্রবীণদের কল্যাণে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে৷ কিন্তু অর্থ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, শিক্ষা, তথ্য, স্থানীয় সরকার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলোকে বার্ধক্যকল্যাণ বিষয়ে দায়িত্বশীল এবং সক্রিয় করা অনেক জরুরি৷ স্মরণে রাখা উচিত যে, দয়া-দাক্ষিণ্য নয়, অধিকার আর প্রাপ্য সন্মানের হিস্যা নিয়েই প্রবীণ নাগরিকরা অনিন্দ্য সুন্দর এই বাংলাদেশে মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতে চান৷

Dr. ASM Atiqur Rahman, Dhaka University
ড. এ এস এম আতীকুর রহমান, মহাসচিব, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘছবি: privat

৮. বর্তমানে দেশের প্রায় ১৫ লাখ প্রবীণ অবসরকালীন পেনশন ভোগ করছেন৷ ৩৫ লাখ দরিদ্র প্রবীণ পাচ্ছেন বয়স্কভাতা৷ শুনলে লজ্জা পাবেন, বেশ কয়েক লাখ প্রবীণ জীবন ধারণ করছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে! মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত প্রবীণদের কিন্তু কষ্টের সীমা নেই৷ এছাড়া প্রবীণ নারী, প্রতিবন্ধী, সমাজবিচ্ছিন্ন এবং উদ্বাস্তু প্রবীণদের কথা ভাবার এবং লাগসই ব্যবস্থা নেয়ার জরুরি প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে৷ দেশের গ্রাম-শহরের প্রতিটি সমাজ প্রবীণবান্ধব করে গড়ে তোলার এখন সময় এসেছে৷ বার্ধক্য বীমা এবং সার্বজনীন নাগরিক পেনশন ব্যবস্থা চালু করা, আরামপ্রদ ও নিরাপদ আবাসন বা প্রবীণনিবাস গড়ে তোলা, পেশাগত ও সাধারণ শিক্ষা পাঠ্যক্রমে বার্ধক্য ও প্রবীণকল্যাণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, গণমাধ্যমে ব্যাপক ও ইতিবাচক বার্ধক্য বিষয়ক প্রোগ্রাম প্রকাশ ও প্রচার করা, সন্মানের সাথে প্রবীণদের দেখভাল করে নিজেদের সফল বার্ধক্যের  প্রস্তুতি নিতে নবীন ও তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা, রাস্তা-ঘাট, দালান-কোঠা, হাট-বাজার, নাগরিক সেবাকেন্দ্র, ব্যবহার্য্য প্রযুক্তি প্রবীণ বান্ধব করা ইত্যাদি পদক্ষেপ আমাদের নিতে হবে এখনই৷ জাতিসংঘে খুলতে হবে প্রবীণ বিষয়ক স্বতন্ত্র এজেন্সি আর বাংলাদেশে করতে হবে প্রবীণকল্যাণ বিষয়ক স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়৷ এসব উদ্যোগে অবশ্যই প্রবীণদের জড়িত করতে হবে৷ তাহলে মেধা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা আর বিচক্ষণতা দিয়ে তাঁরাই পারবেন সকলের জন্যে সমান উপযোগী বাংলাদেশ গড়ার লাগসই পরামর্শ দিতে, কেননা, প্রবীণের যুক্তি আর নবীণের শক্তি, এই দুয়ে মিলে সমাজের মুক্তি৷ 

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

ড. এ এস এম আতীকুর রহমান, মহাসচিব, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ৷ অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷