প্রিয় সন্তানকে যৌন নিপীড়নে ঠেলে দিচ্ছেন না তো?
৩০ অক্টোবর ২০১৮বিকারগ্রস্ততা থেকে যৌন অপরাধ ঘটে চলেছে প্রতিটি জায়গায়৷ ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী, বাদ পড়ছে না শিশু৷ শৈশবে নিপীড়নের এই অভিজ্ঞতা ছাপ ফেলতে পারে তার সারা জীবনে, তার মধ্যে দেখা দিতে পারে অস্বাভাবিকতা৷
ছেলে-মেয়ে যে-ই হোক না কেন, তার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বাবা-মায়ের আন্তরিকতা, সমগ্র চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে এরকম কোনো বিকৃতির ছোবলে৷ এই পরিস্থিতিতে নিজের সন্তানকে কীভাবে এই সব কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে প্রতিটি অভিভাবককে৷ চলার পথের প্রতিটি বাঁকে যখন অসংখ্য কাঁটা, সেখানে তার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা তৈরি হয়ত সম্ভব নয়৷ তবে নিজের সামর্থ্যের মধ্য থেকে যতটা সম্ভব চেষ্টা করতে হবে৷
এর জন্য প্রথমেই সন্তানের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে বন্ধুত্ব৷ তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠতে হবে বাবা-মা-কে৷ ধীরে ধীরে যৌনাঙ্গ সম্পর্কে ধারণা এবং সেগুলোতে অন্যের আগ্রহ যে তার জন্য ক্ষতিকর, সে বিষয়টি বোঝাতে হবে৷ কেউ এ ধরনের ইঙ্গিত করলে তা যেন বাবা-মায়ের কাছে অকপটে বলতে পারে সেরকম সম্পর্ক তৈরি করতে হবে৷ বাবা-মা-কে কাছে না পেলে বলতে হবে অন্যদের, যাতে অপরাধীর কাছ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়৷
শিশু যৌন নির্যাতনের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, শিশুরা তার পরিবার বা নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে৷ এদিকে সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে৷ সমবয়সি নিকটজন তা সে সম বা বিপরীত লিঙ্গ যা-ই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে মেশার মধ্য দিয়ে সে বিপথে যাচ্ছে কিনা, সে দিকেও চোখ রাখতে হবে৷
বাংলাদেশে শিশুদের যৌন নিপীড়নের আরেকটি ভয়াবহ দিক রয়েছে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক৷ বিভিন্ন জায়গায় হুজুরের হাতে শিশুদের নিপীড়িত হওয়ার খবর আসে পত্রিকার পাতায়৷ তাই শিশুকে এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঠালে নিয়মিত তার খোঁজ-খবর নিতে হবে৷
পশ্চিমা দুনিয়ায় এখন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে আরেক ধর্মীয় উপাসনালয় চার্চে যাজকদের হাতে শিশুদের নিপীড়িত হওয়ার খবরে৷ সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে বছরের পর বছর ধরে এভাবে শিশু যৌন নির্যাতনের খবর বেরিয়ে এসেছে৷
এই দুই ক্ষেত্রে ব্যক্তির পাশাপাশি ওইসব প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে৷ ব্যক্তি পর্যায় থেকে শিশুকে যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ ড. ক্যাথরিন সেইফার্ট৷ সে দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় তাঁর এই পরামর্শগুলো আমাদের সমাজেও কাজে দেবে৷ তাঁর পরামর্শগুলো এরকম:
শিশুরা যেন সারা দিনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলে, সেজন্য তাদের উৎসাহিত করতে হবে৷ যৌন অপরাধী থেকে ব্যক্তিকে কখন ‘না' বলতে হবে বা তার কাছ থেকে সরে আসতে হবে, সেই পরিস্থিতি শিশু ধরতে পারবে, তা আশা করা ঠিক নয়৷ এটা তার জন্য খুবই বিভ্রান্তির হতে পারে৷ এজন্য নিয়মিত তাদের সঙ্গে সারা দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করতে হবে৷ যে কোনো বিষয় তুলতে যেন অস্বস্তি বোধ না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে৷ তখন আপনার সন্তান যদি কারো কোনো অপ্রত্যাশিত আচরণের কথা উল্লেখ করে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব আপনার৷
যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে নিজেকে জানতে হবে৷ প্রতি ছয়টির মধ্যে একটি মেয়ে ১৮ বছর বয়সের আগেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়৷ ধরা পড়ার আগে নিপীড়করা গড়ে ১১৭ বার এই কাজ করে এসেছেন৷ এ তথ্যগুলো আপনার জানা না-ও থাকতে পারে৷ তাই প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে৷ যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করাটা গুরুত্বপূর্ণ৷
যৌন অপরাধীরা প্রায়ই বাবা-মা বা শিশুর আস্থা অর্জন করতে চেষ্টা করে৷ খুব চতুরতার সঙ্গে আপনাকে বোকা বানিয়ে তারা সফলও হতে পারে৷ তবে এসব ক্ষেত্রে সব সময় কোনো-না-কোনো অস্বাভাবিকতা থাকে, সেটাই আপনাকে ধরতে হবে৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো ব্যক্তির বাসায় অনেক খেলনা ও ভিডিও গেমস থাকলে এবং প্রতিদিন সেখানে এলাকার অনেক শিশু গেলে, তাকে সন্দেহের তালিকায় নিতে হবে৷ আবার কোনো ব্যক্তির পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা সে ধরনের কর্মকাণ্ড না থাকলে তার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে৷ ওই ব্যক্তিকে যাচাই করতে হবে৷ সম্ভব হলে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে৷ তার বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের আগের কোনো অভিযোগ থেকে থাকলে দ্রুত তার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে৷
আপনার সন্তান কোথায় যায় এবং কাদের সঙ্গে থাকে, তা আপনাকে জানতে হবে৷ সন্তানের বন্ধু-বান্ধব এবং তাদের বাবা-মা সম্পর্কে জানতে হবে৷ তাদের বাসায় সন্তানের সময় কাটানো নিরাপদ, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই তাকে যেতে দিতে হবে৷
আপনার সন্তানসহ অন্য শিশুদের গাইড হিসেবে যেন একজনের বেশি লোক থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে৷ তাদের সবার সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে৷ প্রাপ্তবয়স্ক এসব ব্যক্তিকেও একে অপরের ওপর নজর রাখতে হবে৷ খোলামেলা কথা বলতে হবে তাদের সঙ্গে৷ মনে রাখতে হবে, যৌন অপরাধ সংক্রান্ত সন্দেহের বিষয়গুলো গোপন করা এবং সে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে না চাওয়াটাই যৌন অপরাধীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য৷
সন্তানকে শেখাতে হবে যে, তার বা তাদের আস্থাভাজন লোকের কাছ থেকেও বিপদ আসতে পারে৷ তাদের বলতে হবে, ‘‘খারাপ স্পর্শ সব সময় খারাপ স্পর্শ এবং তা তোমার দেহে কেউ করতে পারে না৷ কেউ তোমার সঙ্গে তা করতে চাইলে অন্যদের কাছে সহযোগিতা চাইতে হবে৷''
কোনোভাবে শিশু যৌনতায় সম্পৃক্ত হলে তার মধ্যে কিছু আচরণগত পরিবর্তন চলে আসে৷ সে বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে৷ তার ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, অন্যদের সঙ্গে আচরণসহ নানা দিকে পরিবর্তন দেখা দেয়৷
সন্তান নিপীড়নের শিকার হচ্ছে বলে সন্দেহ হলে জরুরি ভিত্তিতে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হতে হবে৷
উপরের এই আলোচনা ও পরামর্শ আসলে শিক্ষিত ও সংবেদনশীল মানুষের জন্যই বেশি প্রযোজ্য৷ এর বাইরেও ভিন্ন একটি বাস্তবতা রয়েছে আমাদের দেশে৷ বাল্যবিয়ে এখনো বাংলাদেশে বড় সমস্যাগুলোর একটি৷ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয় তার চেয়ে অনেক বেশি বয়সি পুরুষের সঙ্গে৷ এর মধ্য দিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় অনেক মেয়ে৷
আবার প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে সমাজে রয়েছে খুবই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি৷ কোনো ছেলে-মেয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বললে, বন্ধুত্ব গড়ে তুললে বা ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ালে অনেক সময় জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় মেয়েটিকে৷ কথিত পারিবারিক ‘সম্মান রক্ষা' বা সম্পদশালী জামাতার অর্থের লোভে তার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় মেয়েটির আপত্তি অগ্রাহ্য করে৷ এতে সারা জীবনের জন্য তার প্রিয় সন্তানটি একটি নিপীড়নের জীবনে চলে যাচ্ছে কিনা, তা ভেবে দেখার সময় হয় না বাবা-মায়ের৷ নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী সন্তানের ভালো করতে গিয়ে যদি তাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, তা কী ভয়াবহ হতে পারে সেটা একটু ভেবে দেখতে হবে৷
তাই শিশুকে যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষায় বাবা-মায়ের সচেতনতা ও সজাগ দৃষ্টির সঙ্গে একটি মুক্ত, মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে৷