প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে আজ ইটালির অবস্থা বেহাল
২৫ অক্টোবর ২০১১গ্রিসের আর্থিক সংকট নিয়ে যারা দুশ্চিন্তায় ভুগছে, তাদের কাছে ইটালির সম্ভাব্য সংকটের মাত্রা ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন৷ তার উপর ক্ষমতায় রয়েছেন চরম বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রী সিলভিও ব্যার্লুস্কোনি৷ একদিকে বিশাল ঋণের বোঝা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুকাল ধরে থমকে রয়েছে৷ সমালোচকরা বলছেন, ঠিক সময় প্রয়োজনীয় সংস্কার করলে আজ এমন দুর্দশা হতো না৷ এখন দেশকে কীভাবে সংকট থেকে বার করে আনা যায়, বুধবারের মধ্যে সেবিষয়ে সরকারকে সুস্পষ্ট প্রস্তাব পেশ করতে হবে৷
যথাসময়ে সংস্কারের অভাব
ইউরোপের প্রায় সব দেশেই সামাজিক নিরাপত্তার কাঠামো চালু রয়েছে৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জার্মানি সহ বহু দেশ তার মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে আসছে৷ কিন্তু গ্রিস বা ইটালির মতো দেশে এবিষয়ে কার্যত কিছুই করা হয় নি৷ যেমন ইটালিতে কোনো অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি মারা গেলে তার অবসর ভাতা পুরোপুরি বন্ধ করা হয় না৷ উত্তরাধিকার সূত্রে সেই ভাতার ২৫ শতাংশ পায় তার ভাই বা বোন৷ এমন অবাস্তব রীতি অবসর ভাতার গোটা কাঠামোকেই কার্যত অচল করে দিচ্ছে৷ রোমের অধ্যাপক পিয়েত্রো রাইশলিন এবিষয়ে বললেন,
আগামী দুই তিন বছরের মধ্যে অবসর ভাতার কাঠামোয় এক মারাত্মক সমস্যা দেখা দেবে৷ কারণ ইটালিতে বিশাল সংখ্যক মানুষ নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে থেকেই এই ভাতা পেতে শুরু করেন৷ তার উপর কর্মজীবনে তারা যে মাশুল জমা দেন, তার তুলনায় অবসর ভাতার অঙ্ক অনেক বেশি৷ এই ঘাটতি পূরণ করা কার্যত অসম্ভব৷
প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে ইটালি
ইটালির অনেক বয়স্ক মানুষ এই সুবিধা ভোগ করছেন ঠিকই, কিন্তু বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অবস্থা মোটেই ভালো নয়৷ বেকারত্বের হার প্রায় আকাশছোঁয়া৷ ২৫ বছরের কমবয়সি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রায় ২৮ শতাংশই বেকার৷ এর ফলে তাদের মনে ক্ষোভ বেড়ে চলেছে৷ সেইসঙ্গে গোটা দেশের উদ্ভাবনী ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে শিল্পপতিরা মনে করছেন৷ অপেক্ষাকৃত ছোট ও কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে ইটালির পক্ষে তরুণদের প্রতি উদাসীন থাকার বিলাসিতা মানায় না বলে তারা মনে করেন৷ অতএব বিশ্বায়ন ও প্রতিযোগিতার বাজারে বাকি দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ তাছাড়া ইটালির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে আরও একটি বড় বাধা রয়েছে৷ কোনো শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানকে পদে পদে এত বেশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়, যে তাদের পক্ষে কাজ করাই কঠিন হয়ে ওঠে৷ বিচার ব্যবস্থাও তাদের মাথাব্যথার আরেকটি কারণ৷ একবার আদালতের দ্বারস্থ হলে মামলার নিষ্পত্তি হতে এত বেশি সময় লাগে, যে অর্থ, সময় ও শক্তির বিপুল অপচয় হয়৷
দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ
ইটালির মানুষের সামনে অবশ্য এক বিকল্প পথও খোলা আছে৷ তাড়া থাকলে কিছু বাড়তি খরচ করতে হয়৷ ব্যস, কাজ হয়ে যায়৷ দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের ফলে ইটালির অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছে অনেক সংগঠন৷ তাদের অনেকের কাছে ইটালির রাষ্ট্রীয় কাঠামো অনেকটা কমিউনিস্ট কোনো দেশের মতো৷ গুরুত্বপূর্ণ পদে পছন্দের প্রার্থীকে বসানো হয়৷ যেখানে একজন হলেই কাজ চলে যায়, সেখানে পাঁচ জনকে নিয়োগ করা হয়৷ আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের কোনো উপকারের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হয়৷ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাওয়া কর বাবদ অর্থ দিয়ে এই ব্যবস্থা চালু রাখা হয়৷
অসম উন্নয়ন
ইটালি যেন একটি দেশ নয়, কার্যত দু’টি ভাগে বিভক্ত৷ বিশেষ করে অবকাঠামোর ক্ষেত্রে এই বিভাজন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে৷ উত্তরে রাস্তাঘাট, হাইওয়ে, রেলপথ মোটামুটি উন্নত হলেও নেপলস শহরের দক্ষিণে অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল৷ সহজে কোথাও পৌঁছানো বড়ই কঠিন৷ ফলে দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলিও সড়ক বা রেল যোগাযোগের অভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারছে না৷
এর মধ্যে কোনো সমস্যাই রাতারাতি সৃষ্টি হয় নি৷ অতীতে অনেক গাফিলতির ফলে আজ ইটালির এমন করুণ অবস্থা৷ ব্যার্লুস্কোনি গত ১৭ বছর ধরে হাইওয়ে সম্প্রসারণের ঝুরিঝুরি প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন৷ বাস্তবে কিছুই ঘটে নি৷ সরকার নিজেই প্রবৃদ্ধির পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে৷
প্রতিবেদন: টিলমান ক্লাইনইয়ুং / সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: হোসাইন আব্দুল হাই