ফরাসি বিপ্লবে শেষ ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ
১০ ডিসেম্বর ২০২২সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ আফ্রিকার একমাত্র প্রতিনিধি মরক্কো৷
ফরাসি লেখক হোসে আলাইন ফ্রাঁলো ইংরেজদের বলেছিলেন, ‘‘আমার প্রিয়তম শত্রু৷'' ঐতিহাসিকভাবেই ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ শত্রুর মতই৷ নেপোলিয়ানের যুদ্ধ, শতবর্ষের যুদ্ধ... কত যুদ্ধই না লড়েছে ইংলিশ চ্যানেলের দুই পাশের এই দুই দেশ৷ দুই দেশই বিশ্বের নানান জায়গায় গড়েছে উপনিবেশ, দ্বন্দ্ব বেঁধেছে সেখানেও৷ ব্রিটিশ ভারতে স্থানীয় স্বাধীনতাকামীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামেও ইংরেজদের বিপক্ষে ফরাসিদের অবস্থান৷
বিশ্বকাপ ফুটবলে দুই দল যখন মুখোমুখি, তখন অনেকেরই শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা৷ ফরাসি অধিনায়ক হুগো লরি আর ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেইন, দুজনেই একসঙ্গে খেলেন টটেনহামে৷ অথচ এখন একজনের গোলে নেয়া শট অন্যজনকে বাঁচাতে হচ্ছে৷ রাফায়েল ভারান খেলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে, ইংল্যান্ডের হ্যারি ম্যাগুয়ারকে পাশে নিয়েই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে খেলেন এই ফরাসি৷ অথচ আজ দুজনের দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে! অলিভিয়ের জিরদের জীবনের গত ১২ বছরের ১০ বছরই কেটেছে লন্ডনে৷
বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে, ঘনিষ্ঠ শত্রুদের এই দ্বৈরথে প্রথম গোলটা অরেলিয়ান চুয়ামেনির৷ মাসখানেক আগে, জুন মাসেই মোনাকো থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউরোতে এই মিডফিল্ডারকে দলে নিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ৷ বিশ্বকাপে চুয়ামেনি এত ভাল খেলছেন যে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সবশেষ মৌসুমে রিয়ালের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গার একাদশে জায়গা হচ্ছে না৷ ফ্রান্সকে ম্যাচের ১৭ মিনিটে গোলের দেখা পাইয়ে দিলেন সেই চুয়ামেনিই৷ বুকাইও সাকার কাছ থেকে চ্যালেঞ্জে বল কেড়ে নিয়ে দিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পেকে, এমবাপ্পে আবার দিলেন উসমান দেম্বেলেকে, তার কাছ থেকে আন্তোয়ান গ্রিয়েজমান হয়ে ফের চুয়ামেনির পায়ে বল৷ ২৫ গজ দূর থেকে চুয়ামেনির শটটা জর্ডান পিকফোর্ড সমস্ত শরীর ডানদিকে ভাসিয়েও ঠেকাতে পারেননি৷
এরপর প্রথমার্ধে ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন হ্যারি কেইন, এমবাপ্পেরও শট জমা পড়ে পিকফোর্ডের হাতে৷ দুই দলই আক্রমণ পালটা আক্রমণ জারি রাখে, কিন্তু গোল আর হয়নি৷ দ্বিতীয়ার্ধে খেলা শুরুর সাত মিনিটের মাথায় বক্সের ঠিক মাথায় সাকাকে ফাউল করলেন সেই চুয়ামেনি, বুটের ডগা দিয়ে ল্যাং মেরেই ফেলেছেন৷ সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির সংকেত রেফারির৷ ১২ গজ দূরে মুখোমুখি দুই বন্ধু, কেইন আর লরি৷ টটেনহামে দুজনের গলায় গলায় ভাব৷ কাল বন্ধুর বিপক্ষে শটটা নিতে গিয়ে একবার থামলেন কেইন, বলটা আবার বসিয়ে মোজাটা টেনে ঠিক করে আবার দৌড়ে এসে শট নিলেন৷ বুলেট গতির সেই শটে থামানোর সাধ্য পৃথিবীর কোন গোলরক্ষকেরই নেই৷
গোল হজমের পরই যেন ফের তেতে উঠল ফ্রান্স৷ বাম প্রান্ত দিয়ে এমবাপ্পে যে দৌড়টা দিলেন, সেটা আল খোর স্টেডিয়াম না হয়ে টোকিও অলিম্পিকে দিলে নির্ঘাৎ ১০০ মিটারে পদক পেতেন৷ যে ক্রসটা করলেন, দেম্বেলে তাতে পা ছোঁয়াতে পারলে গোল হয়, কিন্তু দেম্বেলে যে গতিতে এমবাপ্পের সমকক্ষ নন৷ দৌড়ে বক্সে এসে ঢোকার আগেই বল চলে গেছে বাইরে৷ পরের মিনিটে আদ্রিয়ান রাবিওর জোরাল ভলিও আটকে দিয়েছেন পিকফোর্ড৷ সুযোগ পেয়েছে ইংল্যান্ডও৷ ফ্রি-কিকে হ্যারি ম্যাগুয়ারের হেডটা লরির আওতার বাইরেই ছিল, গোলপোস্টে চুমু খেয়ে চলে গেছে গোললাইনের বাইরে৷
৭৬ মিনিটে ম্যাচের সবচেয়ে সেরা সেভটা করেছেন পিকফোর্ড৷ এমবাপ্পের ক্রস, দেম্বেলে হেডে সেটা মাটিতে নামালেন, একদম পিকফোর্ডের মুখের সামনে থেকে জিরুদের জোরাল ভলি ইংল্যান্ড গোলরক্ষক কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করলেন৷ সেই কর্নারই অবশ্য কাল হল৷ কর্নারের ক্লিয়ারেন্সে বল বক্সের বাইরে চুয়ামেনির পায়ে, দিলেন বামে থাকা গ্রিয়েজমানকে৷ গ্রিয়েজমানের মাপা ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে ফ্রান্সকে এগিয়ে দেন জিরদ৷ নির্ধারিত সময় শেষের ১২ মিনিট আগে ফের এগিয়ে যায় 'লে ব্লু'রা৷
সেই অগ্রগামিতাও থাকত না, যদি না কেইন ম্যাচে দ্বিতীয়বারের মত পেনাল্টি নিতে যেতেন এবং মিস করতেন৷ ৭৯ মিনিটে মাঠে নামা মেসন মাউন্ট বক্সের ভেতর লংবলের আশায় ছুটছিলেন, এমন সময় পেছন থেকে অনেকটা দৌড়ে এসে তাকে ধাক্কা মারেন থিও হার্নান্দেজ৷ শুরুতে রেফারি এড়িয়ে গেলেও ভিএআরে দেখে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত জানান৷ আবারও কেইন-লরি মুখোমুখি৷ তবে এবারে কেইন পোস্টের উপর দিয়ে উড়িয়ে বল নিয়ে ফেললেন গ্যালারিতে৷ তাতে চুপসে যাওয়া ফুসফুসে হাওয়া ফিরে এল ফরাসিদের৷
বাকি সময়টায় আর কোন বিপদ নয় ফরাসিদের৷ একদম শেষ মুহূর্তে, বক্সের ঠিক বাইরে ফ্রি-কিক পেয়েছিল ইংল্যান্ড৷ মার্কাস রাশফোর্ডের নেয়া শটটা অল্পের জন্য ক্রসবারের উপর দিয়ে গিয়ে লাগে জালে৷ এরপর বল মাঠে ফিরতেই রেফারির লম্বা বাঁশি৷