ফেসবুকের লাভ-ক্ষতি
২৫ অক্টোবর ২০১৯২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু, ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নাসির নগর আর ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর ভোলার চর বোরহানউদ্দিন - তিনটি ঘটনাতেই অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে ফেসবুক৷
ফেসবুকে মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে কটুক্তি করা হয়েছে এই অজুহাতে রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর আর বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল৷ নাসিরনগরে বলা হয়েছিল ফেসবুক পোষ্টে মুসলমানদের কাবা ঘরের সঙ্গে হিন্দু দেবতা শিবের ছবি জুড়ে দিয়ে ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে৷ সেই কারণ দেখিয়ে হামলা হলো এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর৷ এবার ভোলাতেও তাই, মহানবী ও ইসলামকে কটাক্ষ করে ফেসবুকে পোষ্ট দেয়া হয়েছে সেই অভিযোগ তুলে শুরু হওয়া বিক্ষোভ সমাবেশে ঝরে গেলো চারজনের প্রাণ৷
বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশের সমাজ জীবনে ফেসবুক নামের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি বেশ ভালভাবেই আসন গেড়ে বসেছে৷ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে ফেসবুক, পরিণত হয়েছে অধিকাংশ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে৷ মাত্র ১৫ বছর বয়সী এই প্রভাবশালী মাধ্যমটিকে সম্প্রতি সমাজের পঞ্চম স্তম্ভ বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ৷ তার মতে, মানুষকে মুক্তভাবে কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছে ফেসবুক৷ এই প্ল্যাটফর্মে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ মুক্তভাবে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভুতি, ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও মতামত প্রকাশের ক্ষমতা রাখে৷ ফলে, মতপ্রকাশের ক্ষেত্রটি কিছুটা গণতান্ত্রিক হয়েছে৷ ফেসবুকের সুবাদে পাবলিক পরিসরে এখন সাধারণ মানুষের কন্ঠস্বরও শোনা যাচ্ছে৷ মতপ্রকাশের পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তি অন্যের সামনে সহজে তুলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছে ফেসবুক৷ সেই সঙ্গে ফেসবুকে সমাজ, রাজনীতি, মতাদর্শ ও ধর্ম-বিষয়ক প্রচার চালানোও খুব সহজ হয়ে গেছে৷
ফেসবুক ব্যবহারে কি লাভ, আর কীইবা ক্ষতি? জিজ্ঞেস করেছিলাম পরিচিত কয়েকজনকে৷ তরুণদের অনেকেই বলছেন, বিজনেস প্রমোট করতে গেলে ফেসবুক খুব কাজের৷ অনেক তরুণ উদ্যোক্তা ফেসবুক ব্যবহার করে পণ্য বেচা-কেনা করছেন৷ ফেসবুকে খুব সহজে, দ্রুত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, একে অন্যের সাথে যোগাযোগ বাড়ছে৷ পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, নতুন বন্ধু তৈরি হচ্ছে৷ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে আপডেট থাকা যাচ্ছে, জানা যাচ্ছে কোথায় কি ঘটলো৷
পাশাপাশি তারা এটাও বলছেন যে, ইদানিং খুনখারাপি, হিংসা-বিদ্বেষ, হয়রানি-হানাহানি ছড়াতেও বড় ভূমিকা পালন করছে ফেসবুক৷ বুয়েট ছাত্র আবরারের খুনিরাও ফেসবুক মেসেঞ্জারে আলোচনা করে তাকে নির্যাতনের পরিকল্পনা করেছিল৷ বরগুনার আলোচিত রিফাত শরিফ হত্যার আগের রাতে জিরো জিরো সেভেন ফেসবুক মেসেজ গ্রুপে রিফাত হত্যার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল৷ এসব কারণেই হয়তো অনেকে খুব রেগে গিয়ে বলেছেন, ফেসবুক হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের ক্যান্সার৷ মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা তার মূল্যবান সময় পার করছে ফেসবুকে অন্যের ব্যক্তিগত জীবন ঘাটাঘাটি করে৷ মানুষ হয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক, অনুভূতিহীন ও সামাজিক দায়-দায়িত্বহীন৷
অনেকে মনে করেন, ফেসবুকের কারণেই এই সময়ে মানুষের মনোভাব বোঝা সহজ হয়েছে৷ বোঝা যাচ্ছে, কারা ভদ্রবেশী মুখোশ পরা শয়তান, আর কারা ধর্মীয় হিংসা তৈরির উস্কানি দাতা৷ জানা যাচ্ছে, ফেসবুক ব্যবহার করে কারা জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে, কারা রামু ভোলা নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরি করেছে, কারা সংখ্যা লঘুদের উপর হামলা চালিয়েছে৷
তাদের মতে, বর্তমানে যত রকমের সামাজিক অস্থিরতা হচ্ছে তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফেস বুকের মাধ্যমেই ছড়াচ্ছে৷ কোন ভাবে একটা লেখা বা ছবি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভাইরাল করতে পারলেই হলো, সত্যতা যাচাই না করেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন মন্তব্য করতে, কেউ কেউ আবার এক কাঠি এগিয়ে নেমে পড়েন মাঠে৷ এক দল আছেন, যারা হয়তো ফেসবুক পোষ্টটা নিজের চোখে দেখেননি, অন্যের কাছে শুনেই হুঙ্কার ছাড়ছেন, মাথা ফাটাফাটি শুরু করে দিয়েছেন৷ তাদের এইসব ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের ফায়দা লোটে দুর্বৃত্ত স্বার্থান্বেষী মহল৷
অথচ, ফেসবুকের লেখা গণমাধ্যমের মতো সম্পাদিত নয়৷ অনেকেই সত্য-মিথ্যা না জেনে, তথ্য যাচাই বাছাই না করে তাৎক্ষণিক ভাবে এমন সব লেখা বা ছবি পোষ্ট করেন বা শেয়ার করেন, যা সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়৷ বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে৷
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই ফেসবুকের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে কথা বার্তা হচ্ছে৷ সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস দাবি করেছে, ফেসবুকের নিউজ ফিড সহিংসতা ছড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এমনো শোনা গেছে রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ চালাতে মিয়ানমারের সেনারা সমন্বিত অনলাইন প্রপাগান্ডা চালিয়েছে৷
এছাড়াও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুক আসক্তি তৈরি করে, যা অনেকের মতে, সিগারেটের নিকোটিনের মতোই ক্ষতিকর৷ ফেসবুকে অন্যের সুখ ও আনন্দ অনেকের মধ্যে ঈর্ষারও জন্ম দেয়৷ কখনো কখনো ফেসবুক মানুষকে উপহার দেয় একাকীত্ব, বিষাদ, বিষন্নতা, দুঃশ্চিন্তা ও হতাশা৷
সব শেষে এই প্রশ্নটি তোলা যেতেই পারে, সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটি অপব্যবহারের দায় কার? এর ব্যবহারকারীর, নাকি স্বয়ং ফেসবুকের? সত্যি বলতে, আমরা কয়জন সচেতন ভাবে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ফেস বুক ব্যবহার করি? বরং দেখা গেছে, অনেকেই যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা না করেই ফেসবুকে ছবি বা বক্তব্য পোষ্ট করেন৷ এর ফলাফল কি হতে পারে তা ভাবেন না৷
অথচ ফেসবুক ব্যবহারের লাভ ক্ষতি নির্ভর করে এর সংবেদনশীল ও সচেতন ব্যবহারের ওপর৷ সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে কতখানি প্রকাশ করবেন, ব্যক্তিগত তথ্য কতখানি দেবেন তার একটা সীমা থাকা উচিত৷ বন্ধু নির্বাচন থেকে শুরু করে ছবি পোষ্ট করা সব বিষয়েই সচেতন থাকা প্রয়োজন৷ দরকার ফেসবুকের সঠিক, উপযুক্ত ও দায়িত্বশীল ব্যবহার৷
সুযোগ-সন্ধানী দুর্বৃত্তদের হাতে পড়লে এই ফেসবুককে যেমন অনৈতিকভাবে ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা সম্ভব, তেমনি আবার ভাল লোকেরা দেশ ও জনগণের কল্যাণেও এই ফেসবুককে ব্যবহার করতে পারেন৷
ফেসবুক থেকে যদি লাভবান হতে চাই, তাহলে এর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে৷ ব্যবহারকারীদের সজাগ, সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে৷ বুঝতে হবে কোনটা সত্য খবর আর কোনটা বানানো অসত্য খবর৷
এখনই সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ ক্ষতির আশংকা আছে৷ যে কোন স্বার্থান্বেষী মহল গুজব বা ভূয়া খবর ছড়িয়ে এই আনন্দময় ফেসবুকের জগতকে বিপজ্জনক ভাবে ব্যবহার করতে পারে দেশের বিরুদ্ধে, জনগণের বিরুদ্ধে৷ যার কিছু কিছু লক্ষণ এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে৷ আরো বড় ক্ষতি হওয়ার আগেই, তাই, আমাদের সতর্ক হতে হবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷