রথ দেখা, বই বেচা
৩১ জানুয়ারি ২০১৭ফ্রাংকফুর্ট বাণিজ্য মেলার চত্বরে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি বসে ‘ফ্রাংকফুর্টার বুখমেসে'৷ সাহিত্যের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের সঙ্গে এই মেলায় আরো চোখ কাড়ে জার্মান দক্ষতা: সংগঠনে, সাজসজ্জায়, আয়োজনে – নাম করব না এমন সব দেশের কবি-সাহিত্যিকদের দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়ে ছাড়ে৷
আগেই বলে রাখি, বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা বলতে প্রকাশকদের সংখ্যার বিচারে; দর্শকদের সংখ্যার বিচারে ইটালির তুরিন শহরের বইমেলাই বিশ্বসেরা৷ তবে ফ্রাংকফুর্ট বইমেলার পরিসংখ্যান শুনলে বেশ খানিকক্ষণ হাঁ করে থাকতে হয়: ১০০টির বেশি দেশ থেকে আসা ৭,০০০ প্রকাশক ও পুস্তক সংস্থা তাদের পুস্তকাবলী প্রদর্শন করেন, যা দেখতে আসেন ২,৮৬,০০০-এর বেশি দর্শক৷ আন্তর্জাতিক বই ব্যবসার কাছে ফ্রাংকফুর্ট বইমেলার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো স্থান বা তারিখ নেই৷
বই মানেই ট্র্যাডিশন, ঐতিহ্য, প্রথা, পরম্পরা৷ ফ্রাংকফুর্টে প্রথম বইমেলা বসেছিল ১৪৫৪ সালে – ইওহানেস গুটেনব্যার্গ যার স্বল্প আগে কাছের মাইঞ্জ শহরে পুস্তক মুদ্রণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে লাইপসিগ বইমেলা ফ্রাংকফুর্ট বইমেলাকে পিছনে ফেলে দিলেও বেশি দিন সেই মর্যাদা ধরে রাখতে পারেনি৷ সপ্তদশ শতাব্দী অবধি যে ফ্রাংকফুর্ট বইমেলা ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা ছিল, একবিংশ শতাব্দীর সূচনাতেও দেখা যাচ্ছে সেই ফ্রাংকফুর্ট বইমেলাই আজ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা৷
কিন্তু কেন? তার নানা কারণ আছে, তবে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বোধহয় এই যে, বই সংক্রান্ত স্বত্ব ও অনুমতি বা লাইসেন্সের আন্তর্জাতিক বেচাকেনার সেরা জায়গা হলো এই ফ্রাংকফুর্ট বইমেলা৷ পাঁচদিনের মেলার প্রথম পাঁচদিনই রাখা যাকে বলে কিনা ইন্ডাস্ট্রির ইনসাইডারদের হাতে – অর্থাৎ যারা বই বেচে খান; শেষ দু'দিন – শনিবার ও রবিবার – আপামর জনতাও বইমেলার পরিবেশ উপভোগ করার সুযোগ পান৷ তবে আসল কথা হলো: বিজনেস ফার্স্ট! প্রকাশনার খোঁজখবর নিন, নেটওয়ার্কিং করুন৷ প্রকাশক, এজেন্ট, বইবিক্রেতা, পুস্তকাগারের পরিচালক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা পত্রিকার সমালোচক, পুস্তক অলঙ্করণ শিল্পী, অনুবাদক, সফ্টওয়্যার ও মাল্টিমিডিয়া বিশেষজ্ঞ বা ফিল্ম প্রযোজক, সকলেরই দেখা মিলবে এই ফ্রাংকফুর্টে৷ শ'খানেক দেশ থেকেআগত দশ হাজারের বেশি সাংবাদিক-সংবাদদাতাদেরও দেখা পাওয়া যাবে৷
২০১৭ সালে যেমন মেলা চলবে ১১ই থেকে ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত: বইমেলার ওয়েবসাইটে এখনই সব খুঁটিনাটি পাওয়া যাবে৷ এ বছর গেস্ট অফ হনার হবে ফ্রান্স, মেলার ফোকাস হবে ফরাসি সাহিত্য৷ এভাবেই এই বইমেলা ইউরোপের সাংস্কৃতিক বর্যপঞ্জীতে তার সুনির্দিষ্ট স্থান করে নিয়েছে৷ যারাই এই মেলার সংস্পর্শে এসেছেন – লেখক বা সাংবাদিক বা নিছক দর্শক হিসেবে – তারাই তাদের নিজস্ব কিছু স্মৃতি সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন ও সযত্নে মনের মণিকোটায় রেখে দিয়েছেন: আমার জীবনে যেটা সুদূর ১৯৮৬ সালের ফ্রাংকফুর্ট বইমেলা, ভারত যেবার প্রথমবারের মতো অতিথি দেশ হয়৷
ডয়চে ভেলের থেকে সাংবাদিক হিসেবে গিয়েছিলাম ফ্রাংকফুর্টে৷ আজও ভুলিনি একদিকে মহাশ্বেতা দেবী বা সমরেশ বসু, অন্যদিকে নির্মল বর্মা বা আগ্নেয়র মতো হিন্দি লেখকদের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা৷ সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ‘দ্য গাইড'-এর লেখক প্রবীণ আর কে নারায়ণের আক্ষেপ: ‘আমার ভাই আমাকে না দেখলে, আজ আমি বেঁচে থাকতে পারতুম না৷' অথবা পাকিস্তানের স্বনামধন্যা লেখিকা কুরাতুলাইন হাইদার যখন তাঁর প্রখ্যাত ‘আগ কা দরিয়া' বইটির বেআইনি পাকিস্তানি ও ভারতীয় সংস্করণ দু'টির কপি তুলে ধরে প্রশ্ন করেন, উপমহাদেশে কপিরাইট বলে কি কিছু নেই?
সুসংবদ্ধ, সুসংগঠিত ফ্রাংকফুর্ট বইমেলার আঙ্গিকে প্রশ্নটা যেন গুম গুম করে উঠেছিল...
বন্ধু, কেমন লাগলো অরুণ শঙ্কর চৌধুরীর লেখা? জানান মন্তব্যের ঘরে৷