বড়দিনের উপহার
২৩ ডিসেম্বর ২০১৩স্যাঁতসেঁতে শনিবারের এক দৃশ্য: শত শত মানুষ কারাগারের লাল ইঁটের দালানের সামনে ভিড় করেছেন৷ অনেকের হাতেই কারাগারের ছাপ মারা ব্যাগ৷ প্রচুর জিনিসপত্র তাতে৷ এতে রয়েছে ক্রিসমাসের রকমারি উপহার, কাঠের তৈরি ছোট ছোট পাখির বাসা, আডভেন্টসক্রানৎস, বিস্কুট ইত্যাদি৷
চারিদিকে উৎসবের আমেজ
জার্মানিতে বড়দিন উৎসবের চার সপ্তাহ আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় ‘আডভেন্টসসাইট বা খ্রিস্টের আবির্ভাবের সময়'৷ চারিদিকে দেখা যায় একটা উৎসবের আমেজ৷ প্রতি শহরেই বসে রকমারি বড়দিনের বাজার৷
প্রতিবছরই এই সময়টায় বার্লিন-টেগেলের কারা কর্তৃপক্ষ শীতকালীন বাজারের আয়োজন করে থাকেন৷ লোকমুখে শুনে শুনে বার্লিনের বাসিন্দাদের কাছেও পরিচিত এই বাজারটি৷ এক প্রবীণা বলেন, ‘‘আমি প্রতিবছর এখানে আসি, কারণ এখানে সুন্দর সুন্দর জিনিস পাওয়া যায়৷'' দুটো আডভেন্টসক্রানৎস কিনেছেন তিনি৷ এছাড়া রকমারি বল ও মোমবাতি দিয়ে সাজানো চারকোণা একটি কাঠের বাক্সও কিনেছেন৷ নাতনির জন্য উপহার এটা৷
নিমেষে খালি হয়ে যায় বাজার
খোলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাজারের টেবিল ও স্টলগুলি খালি হয়ে যায়৷ বিশেষ করে বড়দিনের জিনিসগুলি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে৷ জেলখানার বেকারিতে তৈরি কেকই তো একদিনে বিক্রি হয়েছে কয়েক হাজার ইউরোর৷
জেলের উঁচু প্রাচীরের সামনে আডভেন্টসসাইট-এর এই ডামাডোলটা কারাবাসীদের কাছে পৌঁছায় না৷ ১,২০০ বন্দি আটক রয়েছেন সেখানে৷ তাঁরা ১৪টির মতো ওয়ার্কশপে কাজ করেন৷ বই বাঁধাই থেকে শুরু করে জুতা তৈরি সব ধরনের কাজই চলে সেখানে৷
টেগেল কারাগারের কর্মসংস্থান সেক্টরের ডিটার ব্লাঙ্ক এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমাদের এখানে অনেক কয়েদি রয়েছেন, যারা কারাবাসের আগে নিয়মিত কোনো কাজ করতেন না৷ এখানে তাঁরা কাঠামোটা শিখতে পারেন৷ তাঁরা যথাসময়ে কাজ শুরু করেন৷ নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করেন৷ এরমধ্যে যতটুকু করার ততটুকু কাজ সেরে ফেলেন৷'' সপ্তাহে ৩৭ ঘণ্টা কাজ করতে হয় কারাবাসীদের৷ তাঁদের উৎপাদনের গুণগত মানের ওপর জোর দেওয়া হয়৷ ব্লাঙ্ক বলেন, ‘‘ছাড়া পাওয়ার পরও কয়েদিরা যাতে কর্মজীবনে সম্পৃক্ত হতে পারেন, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখি আমরা৷ একারণে বাইরের শ্রমিকদের মতোই তাদের কর্মদক্ষতা থাকতে হয়৷''
প্রদর্শনী থেকে বাজার
কর্মশালায় তৈরি জিনিসগুলি যেমন খাট, চেয়ার, কাঠের খেলনা ইত্যাদি আগে কিন্ডারগার্টেন ও বিভিন্ন অফিসে পাঠানো হতো৷ এরপর কর্তৃপক্ষ কারা প্রাচীরের বাইরে একটি কক্ষ স্থাপন করে সেখানে তাদের জিনিসগুলি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন৷
কিন্তু আগত দর্শকরা শুধু জিনিসগুলি দেখেই সন্তুষ্ট হননি, ওগুলি কেনার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন৷ এইভাবেই ২০০২ সালে স্থাপিত হয় এক ‘কারাশপ'৷
কিছু নিয়মিত ক্রেতা আসেন এই দোকানে৷ তাঁরা সস্তার জুতা, চামড়ার নানা ধরনের জিনিসপত্র কিনতে পেরে খুশি হন৷ অনেকে আবার পুরানো সোফা ও চেয়ার ঠিকঠাক করার জন্য নিয়ে আসেন৷ ভিড় বেশি বলে প্রায়ই অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় ক্রেতাদের৷ কাঠের ওয়ার্কশপটিতে কারাগারের বন্দিরা বড় বড় আসবাবপত্রের পাশাপাশি ছোট ছোট পাখির বাসাও তৈরি করেন৷ শীতকালে পাখিদের খাওয়ানোর জন্য এই বাসাগুলি অনেকে বাগান ও ব্যালকনিতে ঝুলিয়ে রাখেন৷ এইসব লুফে নেয় মানুষ৷
আত্মমর্যাদা বাড়ায়
কারাগারের এক বন্দি বলেন, ‘‘আমি সাজানোর জিনিস বানাতে পছন্দ করি৷ এর মাধ্যমে আমি সৃজনশীল হতে পারি৷'' ৩৮ বছর বয়সি এই ব্যক্তি কাঠের কর্মশালায় তাঁর কাজটি হারাতে চান না৷ আটক হওয়ার আগে এক রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে কাজ করতেন৷ এখন তাঁর কাঠের কাজ করতে ভাল লাগছে৷
এসব কাজকর্মের মাধ্যমে কারাবন্দিদের আত্মমর্যাদা বাড়ানো হয়৷ জীবনটা যে অর্থহীন নয়, সেটাও বুঝতে দেওয়া হয়৷ কারাবন্দিদের দিয়ে বিনাপয়সায় কাজ করানো হয় না৷ ক্রেতারা এই বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেন৷ এইভাবে পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে লাভবান হতে পারেন৷ বার্লিনবাসীরা প্রাচীরের বাইরে থেকে আর কারাগারের বন্দিরা প্রাচীরের ভেতরে থেকে৷