বন্দুকটি কিন্তু এখনো আছে...
৫ জানুয়ারি ২০১৬বন্দুকবাজরা যখন জাতীয় নিরাপত্তাবাদী রাষ্ট্রের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন তারা বেয়াদব বুদ্ধিজীবীদেরকেই (ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক) মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নেন৷ বুদ্ধিজীবী নিধন ও নির্যাতন তখন হয়ে ওঠে দেশরক্ষার অংশ৷ আর মুক্তবুদ্ধির প্রয়োগ ও মুক্তচিন্তার চর্চা তখন হয়ে ওঠে রাষ্ট্রদ্রোহীতার সমার্থক৷
হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল তাঁর ‘দ্য গ্যারিসন স্টেট' প্রবন্ধে এ বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন৷ জাতীয় নিরাপত্তাবাদী রাষ্ট্রের আকার ও অনাচার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী পাঠক প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন৷ আমি নিজেও আমার সদ্য প্রকাশিত ‘জল্লাদ: ডেথ স্কোয়াডস অ্যান্ড স্টেট টেরর ইন সাউথ এশিয়া' বইটিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক ও আধাসামরিক ঘাতক বাহিনী কর্তৃক গুম ও খুন হওয়া বুদ্ধিজীবীদের কথা লিখেছি৷ লিখেছি ভারত, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধিজীবী নিপীড়নের কথা৷
এক্ষেত্রে অবশ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগণও পিছিয়ে থাকেননি৷ শেখ মুজিবুর রহমান যেমন আল-বদরের আদলে আধাসামরিক রক্ষী বাহিনী গঠন করে সেই রক্ষীদের লেলিয়ে দিয়েছিলেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আর ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে৷ ১৯৭৫ সালের পর ক্ষমতায় আসীন হওয়া পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রাক্তন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় শোষনযন্ত্রের অংশ হিসেবে গঠন করেন ডিজিএফআই৷ সেই থেকে পাকিস্তানের আইএসআই-এর আদলে গঠিত সংস্থাটি বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী নিপীড়নের দায়িত্ব পালন করে চলেছে৷
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে ডিজিএফআই কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিপীড়নের একটি বিবরণ পাওয়া যায় নিউজিল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী এক প্রাক্তন ডিজিএফআই কর্মকর্তার বয়ানে৷ ১৯৯১ সালে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এই কর্মকর্তাটি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত সংস্থাটির কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ও সার্ভেইলেন্স ব্যুরোতে কর্মরত ছিলেন৷ জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারে ধরে আনা ছাত্রনেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন ছিল তাঁর কাজের অংশ — লাঠি দিয়ে পেটানো; নাকের মধ্যে গরম পানি ঢেলে দেওয়া; বন্দিদের খেতে না দেওয়া; চোখ, হাত, পা বেঁধে রাখা; হাতে ও পায়ে ইলেকট্রিক শক দেওয়া; নখের নীচে সুই ঢুকিয়ে দেওয়া৷
এরশাদশাহীর পতনের পরেও কিন্তু এহেন নির্যাতন বন্ধ হয়নি৷ জনগণের ভোটে নির্বাচিত তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির শাসনামলেও ডিজিএফআই কর্তৃক বুদ্ধিজীবী নিপীড়ন চলেছে৷ খালেদা জিয়ার শাসনামলে যেমন সাংবাদিক সেলিম সামাদকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিজিএফআই-এর হেফাজতে৷ বর্বর নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর কয়েক বছরের জন্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি৷ লেখক শাহরিয়ার কবির এবং ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনও খালেদাশাহীর অধীনে ডিজিএফআই-এর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন৷
শেখ হাসিনার শাসনামলেও সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী নিপীড়ন চলছে৷ হাসিনাশাহীর সমালোচক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে ডিজিএফআই-এর তৎপরতার কথা আমরা প্রায়শই শুনতে পাই৷ এক্ষেত্রে বর্তমানে কারাবন্দি আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ঘটনাটি বহুল আলোচিত৷ মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খানের আটকের ঘটনাটিও দেশে-বিদেশে নিন্দিত হয়েছে৷ বর্তমানে অন্তত তিনজন বিএনপিপন্থি সাংবাদিক ডিজিএফআই-এর নিপীড়ন এড়ানোর জন্য বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হয়ে আছেন৷ অন্যদিকে, ডেভিড বার্গম্যানের মতো ‘বেয়াদব' সাংবাদিক আর জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো ‘বেয়াদব' বুদ্ধিজীবীদের আদালত অবমাননার মামলা দিয়ে কাবু করার অর্বাচীন প্রবণতাও আমরা দেখতে পাই একটি বিশেষ আদালতের কার্যক্রমে৷
ডিজিএফআই এবং অন্যান্য সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের জন্য অবশ্য এমনতর আদালতে বিচারপ্রার্থী হওয়ার সুযোগ সীমিত৷ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার অবশ্য চলছে৷ অন্যদিকে মুজিবশাহী, এরশাদশাহী ও খালেদাশাহীর আমলে সংঘটিত বুদ্ধিজীবী নিপীড়নের ঘটনাগুলির সুবিচারের ক্ষেত্রে যে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার আগ্রহী নন তা বলাই বাহুল্য৷ এমনকি তথাকথিত ১/১১-এর সরকারের আমলে ডিজিএফআই কর্তৃক ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের নির্যাতনের ঘটনাগুলির সুবিচারের ক্ষেত্রেও বর্তমান সরকার অনাগ্রহী৷
আমি নিজেও ২০০৭ সালের মে মাসে ডিজিএফআই-এর সদরদপ্তরে আটকাবস্থায় বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম৷ ২০০৮ সালে আমার জবানবন্দির ভিত্তিতে সেই ঘটনাটির একটি বিবরণ প্রকাশ করে ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ'৷ আমাকে চোখ বেঁধে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে যারা সেদিন ব্যাটন আর লাঠি দিয়ে নির্যাতন করেছিলেন, তাদের কি কখনো কোনো আদালতে হাজির হতে হবে? এতগুলি বছর পরেও কিন্তু এই প্রশ্নটির কোনো মীমাংসা হয়নি৷ আমাকে নির্যাতনকারী বন্দুকবাজরা ক্ষমতা হারিয়েছেন বটে, তবে আরেকদল বন্দুকবাজ শেখ হাসিনার মসনদ রক্ষায় নিয়োজিত হয়েছেন৷
মসনদে রদবদল হয়েছে অবশ্যই, বন্দুকটি কিন্তু এখনো আছে৷
বন্ধু, আপনি কি তাসনিম খলিলের বক্তব্যের সঙ্গে একমত? জানান নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷