উধাও হচ্ছে বাংলার লোকশিল্প?
৭ মার্চ ২০১৮অবিভক্ত বাংলার র দুষ্প্রাপ্য সম্ভার নিয়ে ১৯৬৩ সালে জোকায় ৫ বিঘা জমিতে তৈরি হয়েছিল গুরুসদয় মিউজিয়াম৷ নেপথ্যে ছিলেন বাংলার ব্রতচারী সমিতির রূপকার গুরুসদয় দত্ত৷ এখনও শতাধিক বছরের পুরোনো ২০০-রও বেশি নকশিকাঁথার সংগ্রহ রয়েছে এখানে৷ সুজনি, আরশিলতা, বৈতান, দুর্জানির মতো প্রায় সাত রকমের বিরল কাঁথার সংগ্রহ রয়েছে৷ কাঁথার উপর রান, বকেয়া, চেন, ভরাটের সেলাই মনে করিয়ে দেয় সাবেক বাংলার শিল্পরীতি৷ ১৯৮৪ সাল থেকেই প্রধানত বিরল কাঁথার এমন সংগ্রহের জন্য কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রক এই সংগ্রহশালার কর্মীদের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার দায়ভার বহন করে আসছিল৷ কিন্তু আচমকাই মন্ত্রক সেই চুক্তি বাতিল করেছে৷ ফলে পাঁচ মাস ধরে বিনা বেতনে কাজ করে চলেছেন এই জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত থাকা ১৩ কর্মচারী৷ জাদুঘরের কিউরেটর বিজন মণ্ডল ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এর ফলে বাংলার সাবেক লোকশিল্পের বিপুল সংগ্রহ ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে৷ আর এভাবে সরকার যে চুক্তি বাতিল করতে পারে, এমনটা ভাবা যায় না! সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন স্তরে আমরা মিউজিয়ামকে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছি৷ স্থানীয় সাংসদও ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেননি৷ মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও একাধিকবার আবেদন করা হয়েছে৷ এখনও পর্যন্ত আশাপ্রদ কিছুই হয়নি৷ আপাতত নিরাপত্তারক্ষী রাখা হচ্ছে নিজস্ব তহবিলের অর্থ দিয়ে৷ এরপরে তো অর্থের অভাবে দেশের জাতীয় সম্পদ ভীষণরকম ক্ষতির মুখে পড়বে৷''
গত বছর কেন্দ্রের দেওয়া সর্বোচ্চ অনুদানের পরিমাণ ছিল বার্ষিক ৪৫ লক্ষ টাকার মতো৷ কিন্তু সবকিছু রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয়েছিল ৪৬ লক্ষ টাকার মতো৷ এই উদ্বৃত্ত টাকা মিউজিয়ামের তহবিল থেকেই বহন করা হয়েছে৷ কিন্তু এখন হঠাৎ করে এভাবে সরকারের সিদ্ধান্তে আকাশ ভেঙে পড়েছে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের মাথায়৷
শুধু কাঁথা নয়, দুই বাংলার হস্তশিল্প ও লোকশিল্পের তিন হাজারের বেশি উপকরণ রয়েছে এখানকার সংগ্রহে৷ পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার নানা উপাদানের পুতুল, পটচিত্র, আমসত্ত্বের ছাঁচ, মঙ্গল ঘট, হাঁড়ি, শিকা, মাটির পাত্র, দশাবতার তাস বাঙালির সাংস্কৃতিক বিবর্তনস্মরণ করিয়ে দেয়৷
১৯৬৩ সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীর প্রদর্শনশালাটির উদ্বোধন করেছিলেন৷ একেবারে গোড়ার দিকে ব্রতচারী সমিতি অর্থ সংগ্রহ করে এই মিউজিয়ামের তত্ত্বাবধান করতো৷ এরপর ১৯৮৪ সালে কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রক এই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যয়ভার বহনে রাজি হয় এবং তাদের সুপারিশ মেনেই ১৫ সদস্যের পরিচালনা কমিটি তৈরি হয়৷ তৎকালীন রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপেই কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রক কর্মীদের বেতন ও মিউজিয়াম রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ বহন করার চুক্তি করে৷ এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছরই বস্ত্র মন্ত্রক থেকে বরাদ্দ পাঠানো হয়৷ কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ নিজেরাই অর্থ সংগ্রহে সক্ষম৷ তাই কেন্দ্র আর কোনও সাহায্য করবে না৷ বরং তারা বিকল্প কিছু উপায় খুঁজে নিক! এ প্রসঙ্গে বিজন মণ্ডল বললেন, ‘‘মিউজিয়াম অর্থ উপার্জনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না৷ কারণ, মিউজিয়াম শিল্প ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে৷ তাই এই প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে অনুদান লাগবেই৷ এই মুহূর্তে মিউজিয়ামের নিজস্ব কোনও জমি ও বিনিয়োগ করার মতো অর্থ নেই৷ আমাদের কিছু প্রচেষ্টা শুরু করতে গেলে ন্যূনতম বিনিয়োগ তো লাগবে! সেটাও নেই৷''
রংপুরের এয়োঘট, খুলনার চিত্রিত পিঁড়ে ও লাউয়ের শুকনো খোলের মুখোশ, পুরোনো কলকাতার ডোকরার মূর্তি, ময়মনসিংহের পোড়ামাটির খেলনা পুতুল, মাটির মুখোশ আজকের বাঙালিকে গৌরবময় লোকসংস্কৃতির কথা জানান দিলেও জোকার যে প্রান্তিক জায়গায় এই জাদুঘরের অবস্থান, সেখানে বাঙালি দর্শকের ভিড় বেশি হয় না৷ যাতায়াতের অসুবিধার জন্য মূলত গবেষক, শিক্ষক, ছাত্র এদেরই সমাগম হয় দর্শনার্থী হিসেবে৷ কাজেই টিকিট বিক্রি করে বেশি আয় হয় না৷ টিকিট বিক্রি করে বার্ষিক ৮০-৯০ হাজার টাকার মতো আয় হয়৷ তাতে কীভাবে এই বিপুল সংখ্যক শিল্পকলা রক্ষণাবেক্ষণের খরচ সামলানো সম্ভব? প্রশ্ন তুললেন বিজন মণ্ডল৷ ৩২ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন পীযূষ চক্রবর্তী৷ পাঁচ মাস বেতন না পেয়েও হাসিমুখে কাজ করে চলেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানালেন, ‘‘বাংলার এসব ঐতিহ্য আর শিল্পসম্পদগুলোর প্রতি আমাদের ভালোবাসা আর মমতা থেকেই যায়৷ পাঁচ মাস বেতন না পেয়েও কাজটা করে যাচ্ছি তাই৷ অবস্থার পরিবর্তন না হলে বাঙালির বহু মূল্যবান ইতিহাস হারাবে৷ এ দায় বাঙালিরই৷''
অনেক আগেই গুরুসদয় দত্ত বুঝেছিলেন শুধুমাত্র পুঁথিপত্র ও বক্তৃতার জোরে বাংলার চলমান সংস্কৃতিকে ধরে রাখা সম্ভব নয়৷ তাই শিল্পবস্ত্রগুলি সংরক্ষণের কথা ভেবে বাড়ি তৈরির প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন৷ ১৫০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ— এই ৫০০ বছরের বাংলার সংস্কৃতির বৃহত্তর অংশ আর অন্য কোনও সংগ্রহশালায় নেই৷ এমনকি ভারতীয় জাদুঘরেও নেই৷ সেই অর্থে এটি বাংলার অতীত ইতিহাসের ধারক গুরুসদয় মিউজিয়াম৷ অথচ সংকট তৈরির পর কয়েক মাস কেটে গেলেও এখনও সমাধানের আভাস মেলেনি৷ তবে কি বাঙালি সংস্কৃতির এই ধারকের রক্ষার উপায় নেই?