বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের সংকট
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে একনায়কতন্ত্র অথবা স্বৈরাচারী সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন, পরোক্ষভাবে শোষণনীতি গ্রহণ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ৷
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিশ্বে গণতন্ত্র প্রক্রিয়া সুসংহত করা৷
জার্মানির ব্যার্টেলমান ফাউন্ডেশনের গবেষণার তথ্যানুযায়ীও বিশ্বে দুর্বল প্রশাসন ও গণতন্ত্রের সংকট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ এছাড়া বৈষম্য ও নিপীড়ন বিশ্বব্যাপী বাজার অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে৷ বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের রোল মডেল দেশের সংখ্যা কমে যাচ্ছে৷ ফিকে হয়ে আসছে গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী করার প্রয়াস৷
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন লিখেছেন, গণতন্ত্র ছাড়া ‘সবার জন্য উন্নয়ন' নিশ্চিত করা যায় না৷ সেকারণেই অমর্ত্য সেন কমিউনিস্ট ব্যবস্থা সমর্থন করেননি৷ তার ‘দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও পুষ্টিহীনতা' বইয়েও তিনি গণতন্ত্রের অপরিহার্যতা তুলে ধরেন৷ সেখানে প্রফেসর সেন গণতন্ত্রকে একটি শাশ্বত মূল্যবোধ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন৷ তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যার মধ্যে থাকবে বহু দল ও নির্বাচন এবং বিরোধী দলের সমালোচনা যার অপরিহার্য অংশ এবং এমন একটি ব্যবস্থাই পারে দুর্ভিক্ষ রোধ করতে৷ তার ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম' গ্রন্থেও তিনি একই অভিমত প্রকাশ করেছেন৷ উন্নয়নের জন্য উন্মুক্ত গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের উপস্থিতি যে জরুরি তিনি এ কথা জোর দিয়ে বলেছেন৷
যে কোন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি শুধু আমলাশ্রেণি ও প্রতিষ্ঠানই কলুষিত করে না, সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দেয়৷ এটি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু করে দেয়৷ স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন পুলিশ বিভাগ, স্বাধীন গণমাধ্যম ইত্যাদি, যা রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য৷
গণতন্ত্রহীনতা দুর্নীতির বেশে আবির্ভূত হবেই৷ কোনো কিছুই এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না৷ একমাত্র সত্যিকারের একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশেই দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব৷ কারণ, এ রকম পরিবেশেই রাজনীতিবিদেরা জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন৷ পক্ষান্তরে, আমলার কোনো জবাবদিহির বালাই নেই৷ আবার রাজনীতিবিদ ও আমলার মধ্যকার যোগসাজশই দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে৷
এ অবস্থায় রাজনীতিবিদ ও আমলার মধ্যে যোগসাজশ হবে, যদি রাজনীতিবিদ (মন্ত্রী বা এমপি) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত না হন৷ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে, নির্বাচনটা যদি প্রকৃত না হয়, তবে রাজনীতিবিদের জবাবদিহি থাকে না৷
দুর্নীতির সঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে আর গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে৷ গবেষণাগুলোর মূল বক্তব্য মোটামুটি একই রকম৷ যেমন গণতন্ত্র ছাড়া দুর্নীতিমুক্ত সমাজ নির্মাণ করা অসম্ভব, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য, সুশাসন মাথাপিছু আয় বাড়াতে সাহায্য করে ইত্যাদি৷
দেশে যখন গণতন্ত্র বা বহুদলীয় ব্যবস্থা নেই, দলের ভেতরেও যখন গণতন্ত্রের চর্চা অনুপস্থিত, নেতারা যখন আমলাদের মতো আচরণ করেন এবং শত অভিযোগ সত্ত্বেও নেতা পরিবর্তনের কোনো প্রক্রিয়া নেই, তখন দুর্নীতির আগমন ঘটতে বাধ্য৷ কারণ, দুর্নীতিই পারে দলের নেতাদের সম্পদ ও উৎপাদনযন্ত্রের মালিক হতে সাহায্য করতে৷
একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি জবাবদিহির পরিবর্তে সম্পদ বানানোর দিকে মনোনিবেশ করেন৷ কারণ, সম্পদ হলেই তিনি দলের মনোনয়ন পাবেন এবং ভোট কিনতে পারবেন৷ দুর্নীতি করলে যেহেতু শাস্তি হয় না, তার জন্য দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ বানানোই বুদ্ধিমানের কাজ বলে তিনি মনে করেন৷ ভোটারবিহীন নির্বাচন বা সবার অংশগ্রহণের নির্বাচন, দুই ক্ষেত্রেই তিনি আবারও নির্বাচিত হবেন-এই মনস্তত্ত্ব দ্বারাই সংসদ সদস্যরা তাড়িত৷
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতেও গণতন্ত্রের সঙ্কট তীব্রভাবে মাথা চাড়া দিচ্ছে৷ ভারতে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে মোদি সরকার স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের আজ্ঞাবহ করার অভিলাষ চরিতার্থ করছে৷ সরকারের সেই অভিলাষের ছোঁয়া দেশের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে৷ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নির্বাচিত বিচারকেরা নির্দিষ্ট বিষয়ে রায় দিচ্ছেন৷ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে চারজন জ্যেষ্ঠ বিচারক এক নজিরবিহীন একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন৷ প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে রায় প্রভাবিত করতে নির্দিষ্ট বিচারকদের নির্দিষ্ট মামলার বিচার করতে দেওয়ার অভিযোগ তারা করেছেন৷
ভারতের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা ব্যাখ্যা করে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাজনৈতিক স্পর্শকাতর মামলাগুলো বেছে বেছে এমন বেঞ্চে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে কোনো জ্যেষ্ঠ বিচারক নেই৷ মামলার রায় যেন সরকারের পক্ষে যায়, সে জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ প্রশান্ত ভূষণের আরও অভিযোগ, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল প্রধান বিচারপতিকে ঘুসের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে একের পর এক ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে৷
মোদি সরকার ভারতের যেসব প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিতে ধ্বংস শুরু করেছে, তাদের মধ্য থেকে সেনাবাহিনীও বাদ পড়েনি৷ ভারতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সেনাপ্রধান নিয়োগ করার রেওয়াজ বহু পুরানো৷ পুরানো সেই রীতি ভেঙে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে জেনারেল বিপিন রাওয়াতকে মোদি সরকার সেনাপ্রধান করেছে৷ সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বিপিন রাওয়াত মোদি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে যাচ্ছেন৷ যা ভারতের আগের কোনো সেনাপ্রধানের ক্ষেত্রে কখনোই দেখা যায়নি৷
ভারতে এত দিন সবার শ্রদ্ধার জায়গা ছিল যে নির্বাচন কমিশনের উপর তার বিরুদ্ধেও মোদি সরকারের স্বার্থে ভোটের তারিখ এগোনো-পেছানোর অভিযোগ উঠেছে৷ এই মুহূর্তে ভারতের হাতে গোনা দু-একটি ছাড়া সকল সংবাদমাধ্যম মোদি আর তার রাজনীতির ‘চিয়ারলিডারে' পরিণত হয়েছে৷ তারা সরকারের সমালোচনামূলক রিপোর্টিং শুধু এড়িয়েই যায়৷ সেই সাথে সরকারের পক্ষে ইনিয়ে-বিনিয়ে রিপোর্ট করতে থাকে৷ সব চেয়ে আতঙ্কের বিষয় সমাজের একটি বিরাট অংশ মোদি সরকারের এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পক্ষে হাততালি দিচ্ছে৷
সংবাদমাধ্যমের মান কোথায় নেমেছে, তা সম্প্রতি কোবরাপোস্ট ওয়েবসাইটের স্টিং অপারেশন থেকেই বোঝা যায়৷ হিন্দু জাতীয়তাবাদী গ্রুপের প্রতিনিধি সেজে ওই ওয়েবসাইটের লোকজন ভারতের বড় বড় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের সঙ্গে দেখা করেন৷ ছদ্মবেশী লোকেরা আসন্ন নির্বাচনে যাতে বিজেপি উপকৃত হয়, সে জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য গণমাধ্যমগুলোকে প্রস্তাব দেন এবং বিনিময়ে তাদের লাখ লাখ ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দেন৷ সিংহভাগ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে এই কাজ করার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়৷
এখানে মূল যে আশঙ্কা সবার মনে দেখা দিচ্ছে, সেটি হলো ব্যাপক জনপ্রিয় থাকা অবস্থায় মোদি সরকার যদি এভাবে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে দলের জনপ্রিয়তা যখন আরও কমে যাবে এবং সেই অবস্থায় তাকে যখন নির্বাচনে জিতে আসতে হবে, তখন দলকে জেতানোর জন্য তিনি কী পর্যায়ের অগণতান্ত্রিক আচরণ করবেন? সঙ্গত কারণেই ধারণা করা যায় ভারতে গণতন্ত্রের সঙ্কট না কমে বরং আরো বাড়বে৷
অন্য দিকে আমেরিকার গণতন্ত্রের সেই আদি যুগ আর নেই৷ সেখানেও অনুপস্থিত ভোটারদের ভোট দেওয়া হয়েছে উনিশ শতকে৷ কোনো কোনো সময় ‘গ্রেভ ভোটার্স' বা কবরে শায়িত ভোটারদের ভোট দেওয়া হয়েছে৷ চেনাজানা সব পন্থায় ভোট কারচুপির ইতিহাস আমেরিকায় ৫০ বছর আগেই সাঙ্গ হয়েছে৷
২০১৬ সালের নির্বাচনে ভোট কারচুপির কথা আবার ব্যাপকভাবে শুনেছেন সারা বিশ্বের মানুষ৷ পরাজিত ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে যেমন কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছে, তেমনি অভিযোগ করেছেন বিজয়ী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পও৷ আবার কট্টর ষড়যন্ত্রতত্ত্ববাদীদের মতে, রাশিয়া অবশ্যই আমেরিকার নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে৷ রাশিয়ার সাহায্যেই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন৷ এসব প্রশ্ন এখনো মিলিয়ে যায়নি৷
ব্রিটিশ অধ্যাপক নিক চিজম্যান ও মার্কিন রাজনীতিবিজ্ঞানী ব্রায়ান কেলাস লিখেছেন, বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী বহু সরকার আইনের কোনো লঙ্ঘন না করেই নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে৷ এর নানা উদাহরণও দিয়েছেন তারা৷ বলেছেন, সাম্প্রতিক দশকে সারা বিশ্বেই গণতন্ত্রের মান কমে যাচ্ছে৷
ফ্রিডম হাউস নামক সংগঠনের মতে, ২০০৬ সালের পর থেকে বিশ্বে কর্তৃত্ববাদ বাড়ছে৷ কমছে গণতন্ত্রের আবহ৷ বিশ্বের সব মানুষের তিনজনের মধ্যে দুজনের বসবাস এখন পূর্ণ গণতন্ত্র নয়-এমন পরিবেশে৷ বিশ্বে নাকি এখন গণতন্ত্রের মহামারি চলছে৷ আমেরিকাতেও দেখা দিয়েছে গণতন্ত্রের সংকট!
যা ঘটছে তা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার সংকট, তা থেকে মার্কিন শাসক-শোষক শ্রেণির অভ্যন্তরীণ সংকটের বহিঃপ্রকাশ৷ তারা সংকটের সমাধান দিতে অক্ষম৷ সংকট তীব্র হলে তারা জনগণকে বিভক্ত করে এবং যুদ্ধ বাধিয়ে সাময়িক পরিত্রাণ খোঁজে৷
ঐতিহাসিকভাবে আমরা দেখি, রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে মূলগত পার্থক্য খুব সামান্য৷ শাসক-শোষকদেরই দুই দল লক্ষ্যে ভিন্নতা নেই, কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য৷ শোষণের ধারাবাহিকতায়, আমেরিকানরাই বলে যে, সম্পদের ভাগাভাগি হয়েছে ১% ও ৯৯%৷ এক শতাংশ মানুষের হাতে ৯৯ শতাংশ সম্পদ৷ আর নিরানব্বই শতাংশ মানুষের ভাগ্যে এক শতাংশ সম্পদ৷ অঙ্কের এই প্রকাশভঙ্গি অতিরঞ্জিত হতে পারে তবে ধনবৈষম্য অবশ্যই অতিশয় প্রকট৷ আমরা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সময় গ্লোবালাইজেশন-বিরোধী, করপোরেট-বিরোধী, ওয়াল স্ট্রিট-বিরোধী অনেক আন্দোলন দেখেছি৷ এগুলোর আওয়াজ বৈষম্যবিরোধী৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি ও তাদের দুটো দল এ সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারবে না৷ জাতীয় ও ভূরাজনৈতিক আরো অনেক সংকট বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের৷ তাতে তারা বিশ্বের প্রধান শক্তির অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না৷ উৎপাদিকা শক্তির সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রাধান্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে চীনের কাছে আমেরিকা এরই মধ্যেই হেরে গেছে৷ আজ হোক কাল হোক, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি ইউরোপ থেকেও মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে৷ তখন সংকট আরো বাড়বে৷
ট্রাম্প শপথ গ্রহণের পর তিনি শুরুই করেছিলেন মিডিয়াকে দেশের শত্রু আখ্যায়িত করে৷ নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ অনেকেই বলেছেন যে, ট্রাম্প চার বছর ধরে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন যার পরিণতি ক্যাপিটল হিলে হাঙ্গামা৷ কিন্তু কেন এই হামলা?
এই কেনর উত্তরে আমরা খুঁজে পাব মার্কিন শাসকদের ভেতরের দ্বন্দ্বের স্বরূপ৷ এই শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের দীর্ঘদিনের সাফল্য হচ্ছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব অভিযানে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে তারা যে ঘৃণ্য পাপগুলো করেছে- মধ্যপ্রাচ্যের তেল লুণ্ঠনের জন্য সিআইএকে দিয়ে ইরানের মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাত ও হোসেন ফাতেমিকে হত্যা থেকে শুরু করে এই সেদিন সাদ্দাম-গাদাফিকে হত্যা, মাঝে লুমুম্বা হত্যা, আলেন্দে হত্যা, সুকর্ণ উৎখাত, লাতিন আমেরিকায় অসংখ্য সামরিক অভ্যুত্থান, শেখ মুজিব হত্যা, ভিয়েতনামকে নাপামে জ্বালিয়ে দেওয়া, বাংলাদেশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় মদদ - এসবই করেছে মার্কিন জনগণের সমর্থন নিয়ে৷ এসব অমানবিক অন্যায়ে দুই দলেরই সমর্থন৷ দুই দলের বাইরে কোনো রাজনৈতিক শক্তিরই সাধ্য নেই ওই ধনাঢ্য নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে গিয়ে পাত পাড়ে৷
কীভাবে শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখা যায়, তা নিয়েই মতবিরোধ৷ শাসকদের একাংশ মনে করছে গণতন্ত্র সীমিত করে কর্তৃত্বমূলক শাসন চালাতে হবে৷ তারা অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অভিবাসীদের দায়ী করে শ্বেতাঙ্গদের খেপিয়ে দিচ্ছে৷ সাধারণ মানুষকে ‘আমরা' বনাম ‘ওরা' বলে খুব সহজে খ্যাপানো যায়, যাতে প্রকৃত শোষকেরা আড়ালে থাকে৷ গত শতাব্দীর কু ক্লুক্স ক্ল্যানের মতো বর্তমানের কিউ-আনন ও প্রাইড বয়রা এখন ট্রাম্পের ক্যাপিটল হিল আক্রমণের সৈনিক৷
শাসক দলের অপর অংশ মনে করে গণতন্ত্র রক্ষা করেই শাসন চালাতে হবে৷ গণতন্ত্র ধ্বংস হলে পরিণামে আম-ছালা দুই-ই চলে যেতে পারে৷ তাই বাইডেনকে এখন আমাদের ভালো লাগছে৷ অবশ্যই তুলনামূলক বাইডেন ভালো৷ ট্রাম্প বিদায় নিলেও তিনি বাইডেনের জন্য রাজনীতি কঠিন করে যাচ্ছে৷ তবে আমেরিকায় গণতন্ত্রের ক্ষতি হলে অন্যান্য দেশ ও আমাদেরও ক্ষতি৷ কারণ তাতে আমাদের মতো ছোট ছোট দেশেও অনেক ‘ট্রাম্প' খুশিতে আত্মহারা থাকবেন৷ আমরা চাইব, আমেরিকার জনগণ যেন ধনিকশ্রেণির কুক্ষিগত গণতন্ত্রের বেড়া ভেঙে ফেলে আরো উদার গণতন্ত্র গড়ে তুলতে পারে৷