1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশকে চাপে রাখতে সীমান্ত হত্যা?

২৯ ডিসেম্বর ২০২২

বছর শেষে সীমান্তে আরো দুই বাংলাদেশি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএএসএফের গুলিতে নিহত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ডিসেম্বরেই সীমান্তে তিন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হলেন।

https://p.dw.com/p/4LXnx
বিএসএফ (ফাইল ফটো)
বিএসএফ (ফাইল ফটো)ছবি: DW/Prabhakarmani Tewari

আর এই বছরে মোট বিএসএফের হাতে ১৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হলেন।

বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন," বাংলাদেশকে চাপে রাখতেই বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে বিএসএফ। এখানে টাকার ভাগবাটোয়ার বিষয় আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এর তেমন কোনো প্রতিবাদ জানানো হয় না।”

বৃহস্পতিবার ভোরে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা সীমান্তে যে দুই বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন তারা হলেন সাদিক হোসেন(২৩) এবং মংলু (৪০)। এই ঘটনায় আরো দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। বুধবার রাতে কাঁটাতার সংলগ্ন এলাকায় বিএসএফ গুলি করলে হতাহতের ঘটনা ঘটে।  তারা গরু আনার জন্য সীমান্তের ওপারে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

চলতি মাসেই ১০ ডিসেম্বর যশোরের বেনাপোল সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশি নাগরিক শাহিনুর রহমান শাহিনকে(২৮) গুলি করে গুরুতর আহত অবস্থায়   ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই দিন পর মারা গেলেও প্রথমে তার লাশ ফেরত দেওয়া হয়নি। তার পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে আবেদন করলে  ২২ ডিসেম্বর লাশ ফেরত দেয়া হয়।

সীমান্ত হত্যা কমছে না:

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে চলতি বছরের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত  সীমান্তে বিএসএফের হাতে মোট ১৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই গুলিতে নিহত হন। বাকিদের নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। এই সময়ে অপহরণ করা হয়েছে আটজনকে। আহত হয়েছেন ১৫ জন। জানুয়ারি মাসে নিহত হয়েছেন একজন, ফেব্রয়ারিতে এক, মার্চে দুই, জুনে এক, জুলাইয়ে এক, সেপ্টেম্বরে দুই, অক্টোবরে দুই, নভেম্বরে দুই এবং ডিসেম্বরে তিনজন নিহত  হয়েছেন।

২০১৭ সাল থেকে এপর্যন্ত ছয় বছরে সীমান্তে মোট ১৬৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এই সময়ে আহত হয়েছেন ১৪০ জন । অপহৃত হয়েছেন ১১৯ জন।

‘সীমান্ত হত্যা ভারতীয় নীতিরই প্রতিফলন’

এর মধ্যে ২০২১ সালে হত্যা করা হয় ১৯ জনকে। ২০২০ সালে হত্যা করা হয় ৪৯ জনকে। ২০১৯ সালে ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়।  ২০১৮ সালে হত্যা করা হয় ১৪ জনকে।  ২০১৭ সালে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়।

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না ভারত:

ভারত সব সময়েই দাবি করে আসছে সীমান্তে যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তারা অপরাধী। তার গরু চোরাচালানিসহ নান ধরনের পাচার ও অবৈধ কর্মকান্ডে যুক্ত। কিন্তু দুই দেশ অনেক আগেই সীমান্তে মারনাস্ত্র (লেথাল ওয়েপন)  ব্যবহার না করার কথা বলে আসছে। কিন্তু সীমান্তে বিএসএফের হাতে হত্যার শিকার ৯০ ভাগই গুলিতে নিহত হয়েছেন। সীমান্ত হত্যা শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও তারা দিয়েছে বারবার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখছে না তারা।

গত জুলাইয়ে  ঢাকায় সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে দুই দেশ একমত হওয়ার পরেও এপর্যন্ত নয় জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন। 

ওই সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং দাবি করেন, "সীমান্ত এলাকায় সব গুলির ঘটনাই রাতে ঘটে এবং যেসব হতাহতের ঘটনা ঘটে তারা সবাই অপরাধী।”

বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী  বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ অবশ্য তখন বলেন, "বৈঠকে বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যা শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে জোর দিয়েছে। বিএসএফ এনিয়ে এক যোগে কাজ করতে রাজি।”

সীমান্ত হত্যার নেপথ্যে কী?

ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের ( মাসুম) সচিব কিরীটি রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দুই মাস আগেও বলা হয়েছে সীমান্ত হত্যা কমানো হবে। কিন্তু কমছে না। ভারতের সরকার বলছে বিএসএফ তাদের কথা শুনছে না। এটা কীভাবে সম্ভব!”

তার কথা,"এই সীমান্ত হত্যার পিছনে যে গল্প ফাঁদা হয় তাও ঠিক না। তারা বলে সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান হয়। চোরাচালনিদের হত্যা করা হয়। মনে হয় যেন সীমান্তে গরু জন্ম নেয় আর তা বাংলাদেশে পাচার করা হয়। বাস্তবে এইসব গরু আনা হয় ভারতের অভ্যন্তরে দুই-আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে হরিয়ানা, পাঞ্জাব থেকে। গরুগুলো হাঁটিয়ে, ট্রাক, ট্রেনে করে আনা হয়। তখন কেউ দেখে না! তারা আটকায় না। কারণ তারা ভাগ পায়। এখানে আসল কথা হলো দুর্নীতি, ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে সব করা হয়। যখন ভাগ-বাটোয়ারায় মেলেনা তখন বিএসএফ হত্যা করে।”

তিনি বলেন, "বাংলাদেশও এটা নিয়ে কিছু বলে না। কোনো জোরালো প্রতিবাদ করেনা। তারা জো হজুর জি হুজুর করে। এভাবে করলে তো পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। আর ভারত সরকার তো হিন্দুত্ববাদী মনোভাব থেকে মুসলিমদের টাইট দেয়ার কাজে ব্যস্ত।”

বাংলাদেশকে চাপে রাখতে সীমান্ত হত্যা:

বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান মনে করেন, "বাংলাদেশকে চাপের মুখে রাখতে ভারত সীমান্ত হত্যাকে একটা কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে।  বিএসএফ অব্যাহতভাবে সীমান্ত হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা ভারতীয় নীতিরই প্রতিফলন। তারা মুখে সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনার যত কথাই বলুক না কেন বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন আমরা দেখছি না।”

তার কথা,"এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে বিএসএফ যে কারণ দেখায় তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ চোরাচালানি বা অপরাধী হলেও তাকে বিনা বিচারে হত্যা করা আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কোনো সিভিলিয়ানকে এভাবে হত্যা করা যায় না। বিএসএফ আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন করে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে। এর বিরুদ্ধে ভারত সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”

ফেলানি হত্যার পর ভারত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চাপ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে তারা বিচারের আয়োজন করে। কিন্তু তাতেও ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি বলে জানান মানবাধিকার কমিশনের এই সাবেক প্রধান।

তিনি বলেন,"এইসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের দায়িত্ব ভারতের। কারণ যারা এর সঙ্গে জড়িত তারা সেই দেশের নাগরিক। তারা এর বিচার করছে না। চাইলে বাংলাদেশও এখানে বিচার করতে পারে। তবে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং বিচারের দাবিতে বাংলাদেশও যথেষ্ট সোচ্চার নয়।”