বাংলাদেশে বিচার পাওয়ার যত হিসাব-নিকাশ
১৭ ডিসেম্বর ২০২১সবশেষ যে উদাহরণটি সামনে এসেছে তা হলো পুলিশ সার্জেন্ট মহুয়া হাজং-এর বাবা বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার মনোরঞ্জন হাজংকে গাড়ি চাপা দেয়ার মামলা নিতে ঢাকার বনানী থানার গড়িমসি৷ সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার রাতে ১২ দিন পর অবশ্য মামলা নেয়া হয়েছে৷ কিন্তু আসামিরা অজ্ঞাত৷
ওই ঘটনায় পুলিশ ঘটনার পরপরই গাড়িসহ দায়ীদের আটক করেছিল৷ কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের ছেড়ে দেয়া হয়৷ তাদের নাম ঠিকানা সব থাকলেও মহুয়া হাজং-এর এজাহারে তার উল্লেখ নেই৷ আসামিরা এখন অজ্ঞাত হয়ে গেছেন৷ শেষ পর্যন্ত মহুয়া মামলা করতে পারলেও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে৷
মহুয়া হাজং পুলিশের সদস্য হলেও তার চেয়ে অধিক ক্ষমতার ব্যক্তির কাছে তিনি আপেক্ষিকভাবে দুর্বল৷ মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘আমরা জেনেছি ওই ঘটনার জন্য একজন বিচারপতির ছেলে দায়ী৷ পুলিশ ক্ষমতাবান হলেও বিচারপতি আরো ক্ষমতাবান৷ ফলে এখানে মহুয়া হাজং অধিকতর ক্ষমতার কাছে দুর্বল৷ ক্ষমতা এবং দুর্বলতা একটা আপেক্ষিক বিষয়৷ তবে ক্ষমতা থাকতে হবে- সেটা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আর্থিক, জেন্ডার বা ধর্মের- যাই হোক না কেন৷''
সবল আর দুর্বলের প্রতিকার বা বিচার সম্পর্কিত কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক:
- মুক্তিযোদ্ধার জমি দখল করে ১০ তলা ভবন নির্মাণ
মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান৷ কিন্তু এই শ্রেষ্ঠ সন্তানরা কতটা বিচার বা প্রতিকার পাবেন তা নির্ভর করছে তার সামাজিক, আর্থিক বা অন্য ধরনের সক্ষমতা কতটা, তার উপর৷ মুক্তিযোদ্ধা ডা. সিদ্দিকুর রহমানের মোহাম্মদপুরের বাড়ি দখল করে সেখানে ১০ তলা ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে৷ ওই ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ২০১৪ সালে রাতের আঁধারে লোকজন নিয়ে বাড়িটি দখল করে নেন৷ এরপর সেখানে একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন৷
মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান দুদক, রাজউক এবং পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি৷ পরে তিনি দেওয়ানি আদালতে মামলা করেন৷ কিন্তু মামলা চলাকালেই প্রভাব খাটিয়ে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাওয়া হয়৷
- এজাহারে সংখ্যালঘু শব্দ থাকায় মামলা নেয়নি থানা
২০১৪ সালের আগস্টে গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়ন কাউন্সিল বাজারে সংখ্যালঘু রবিদাস ও তার পরিবারের সদস্যদের মারপিট করে জোরপূর্বক ভিটেমাটি দখল করে প্রভাবশালীরা৷ কিন্তু থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে এজাহারে ‘সংখ্যালঘু' শব্দ উল্লেখ থাকায় রবিদাসের মামলা নেয়নি পুলিশ৷ তারা হারান তাদের জন্মভিটা৷
- ধর্ষণের মামলা না নিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে
২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল বগুড়ার মুরইল বাজার থেকে অটোরিকশা যোগে যাওয়ার সময় চালক অটোরিকশা থামিয়ে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করে৷ ধর্ষণের শিকার ওই নারী পরে নিজে থানায় গিয়ে চালক নাজমুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দিতে গেলে বগুড়া সদর থানার ওসি তাকে থানায় বসিয়ে রাখেন৷ সারারাত তাকে সালিশের নামে থানায় বসিয়ে রাখা হয়৷ তারপর প্রভাবশালীদের সাথে পরামর্শ করে নানা অজুহাতে মামলা না নিয়ে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেয়া হয়৷
- শিশু ওবায়দুর রহমান হত্যা মামলার আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে
২০১৮ সালের অক্টোবরে মাদারীপুরের শিবচরে ওবায়দুর রহমান (১০) নামে এক শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়৷ মামলা হওয়ার পর কয়েকজন আসামিকে শিবচর পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তারা বিত্তশালী হওয়ায় কিছু দিনের মধ্যেই জামিনে ছাড়া পান৷ তারপর মামলার চার্জশিট দেয়া হলেও আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ উলটো শিশুটির বাবা রতন চোখদারকে আসামিরা হুমকি দিচ্ছে৷ তিনি বিত্তশালী না হওয়ায় কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না৷
- মুরাদ বনাম আলাল
পদত্যাগী তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় ডিজিটাল আইনে মামলার আবেদন হলেও তা এখনও গ্রহণ করা হয়নি৷ কয়েকটি খারিজও করে দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু একই ধরনের অপরাধে বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা গ্রহণ করা হয়েছে৷
‘মাৎস্যন্যায়ের মতো’
ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায় যারা দুর্বল তারা প্রতিকার পান না৷ যারা সবল তারা আইনকে উপেক্ষা করতে পারেন৷ সবল ও দুর্বল বিষয়টিও নানাভাবে বিবেচনা করা যায়৷ যেমন রাজনীতি, অর্থ, ধর্ম, জেন্ডার এবং সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি৷ আবার এটাও আপেক্ষিক৷
সাবেক বিচারক আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘‘এটা মাৎস্যন্যায়ের মতো৷ ছোট মাছ বড় মাছকে গিলে খায়৷ এটা এখন পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার একটি সিস্টেমে পরিণত হয়েছে৷ আর বড়কে রক্ষার জন্য আইনের নানা মারপ্যাঁচ ব্যবহার করা হয়৷ সহজ করে বলা যায়, যে যত দুর্বল তার বিচার পাওয়ার আশা তত ক্ষীণ৷ আর এই ক্ষেত্রে নারী, শিশু, মুক্তিযোদ্ধা, সংখ্যালঘু এই ধরনের কোনো পরিচয়ই কাজে আসেনা৷ বিবেচনা একটাই কে কত প্রভাশালী৷''
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘সংবিধানে সব নাগরিকের আইনের আশ্রয় পাওয়ার সমান অধিকার আছে৷ কিন্তু সেটা হয় না৷ প্রভাবই আসল কথা৷ এই প্রভাব হতে পারে রাজনৈতিক অথবা আর্থিক৷ নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুরা এমনিতেই দুর্বল তারপর যদি তাদের অর্থ বা রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকে তাহলে দুর্বলতা আরো বেড়ে যায়৷'' তার কথা, নারী দুর্বল বলেই থানা মামলা নেয় না৷ ৯৫ ভাগ মামলাই আদালতে করতে হয়৷
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিচার না পাওয়াকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা৷ ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা তাদের সংখ্যার প্রভাব ব্যবহার করেন৷ আর রাজনৈতিক প্রভাব সবসময়ই ক্ষমতাসীনদের৷ কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মধ্যেও আবার ক্ষমতার বড় ছোট আছে৷ এখানে অপরাধী বড় নেতা হলে তার অপরাধের শিকার ছোট নেতা বিচার পান না৷
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের ব্যাখ্যা হলো, ‘‘সংখ্যালঘুদের মধ্যে ধনি, গরিব, প্রভাবশালী আছেন৷ কিন্তু সংখ্যাগুরুদের কাছে তারা মানসিকভাবে দুর্বল৷ আর সংখ্যাগুরুরা মনে করেন দেশটা তাদের৷ সংখ্যাগুরু যদি ক্ষমতাসীন দলের হন তাহলে তো কথাই নেই৷ যদি ক্ষমতার বাইরে হন তাহলেও তার সাম্প্রদায়িক শক্তি আছে৷ আর এই ক্ষমতা পুলিশও জানে৷ তাই মামলা নিলেও আসামি গ্রেপ্তার হয় না৷ এজাহার পালটে দেয়া হয়৷ বিচারের সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না৷''
সাবেক বিচারক আজিজুর রহমান বলেন, ‘‘পুলিশ রেগুলেশনে বলা আছে মামলা সত্য হোক, মিথ্যা হোক থানাকে তা নিতেই হবে৷ কিন্তু থানা আইনকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতা ও প্রভাব বিবেচনা করে৷ এজন্য তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে প্রভাবশালীর পক্ষে অবস্থান নেন৷ অর্থের প্রভাবতো অর্থ গ্রহণ করেই বোঝা যায়৷ বিচার ব্যবস্থায়ও এই নানামুখী প্রভাব কার্যকর৷''
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘থানাকেই মামলা নিতে হবে৷ এটাই আইন৷ কিন্তু থানা পাশ কাটিয়ে আদালতে পাঠায়৷ এটা প্রভাশালীদের সুবিধা করে দেয়ার জন্যই৷ যেসব ঘটনা নিয়ে হইচই হয়, সংবাদমাধ্যমে শক্ত প্রতিবেদন হয়, দেশের মানুষ প্রতিবাদ করে সেসব ঘটনায় হয়তো মামলা হয়৷ আসামি গ্রেপ্তার হয়৷ কিন্তু সর্বশেষ বিচারে কী হয় তার খবর অনেকেই রাখেন না৷''
মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, ‘‘এই সব কিছুর মূলে রয়েছে বিচারহীনতা৷ রাষ্ট্র নাগরিকদের দায়িত্ব নেয় না৷ সংবিধানে যা আছে তা সেখানেই থেকে যায়৷ রাজনৈতিক দলগুলো ভোট আর ক্ষমতার হিসাব করে৷''
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, গৃহকর্মী হত্যায় মামলা হয় না, আবার প্রভাবশালী কেউ মামলা করার আগেই আসামি গ্রেপ্তার হয় যদি আসামি দুর্বল হয়৷ একই আইনের দুই রকমম ফল৷ তার কথা, ‘‘এখন আইন বিচার সব কিছুই ক্ষমতাবান ও বিত্তবানদের জন্য৷''
ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘থানায় মামলা না নেয়াও একটা দণ্ডযোগ্য অপরাধ৷ এর শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড৷ কিন্তু আদালতগুলো এই দণ্ড কাউকে দিয়েছে বলে আমার জানা নেই৷ এখানেও প্রভাবের বিষয় আছে৷ পুলিশের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আদালত হয়ত সক্ষম নয়৷ আদালত এখানে পুলিশের তুলনায় দুর্বল৷’’