বাংলাদেশে ‘আইএস’-ও আছে...
১৭ নভেম্বর ২০১৫জঙ্গিবাদ এমন কোনো পেশা নয় যে তাদের সার্টিফিকেট দেখিয়ে বলা যাবে যে তারা আছে৷ রাজনৈতিক দল বা স্পোর্টস টিমের মতো তারা নাম, ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে তা প্রকাশ করেও কাজ করে না৷ জঙ্গিদের উপস্থিতি বোঝা যায় তাদের কাজে৷ যে পরিচয়েই কাজ করুক, তাদের কাছে ‘কার্যসিদ্ধিই' আসল কথা৷ আর সেই অর্থে কার্যসিদ্ধির পথে জঙ্গি এবং জঙ্গিভাবাপন্নরা তো বড় বড় পদক্ষেপেই এগোচ্ছে৷ কমপক্ষে ১৬ বছর ধরে চলছে অগ্রযাত্রা৷ গত ১৬ বছরের বড় বড় বোমা ও গ্রেনেড হামলা আর সাম্প্রতিক সময়ের ব্লগার, লেখকদের হুমকি ও হত্যা তারই আলামত৷
বাংলাদেশে প্রথম বড় রকমের বোমা হামলা হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ৭ই মার্চ৷ যশোরে উদীচী শিল্প গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে চালানো বোমা হামলায় সেদিন ১০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছিলেন৷ সে বছরেরই ৮ই অক্টোবরে খুলনার নিরালা আবাসিক এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় সাত জনকে, আহত হয়েছিলেন কমপক্ষে ৩০ জন৷ তারপর ২০০১ সালে রমনা বটমূলে নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন, এখনো শরীরে হামলার ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন শতাধিক মানুষ৷
সেই ঘটনার পাঁচ মাসের মধ্যে হয়েছিল আরো দু'টি হামলা৷ ২৪ ও ২৫শে সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচনি সভায় চালানো সেই দু'টি হামলায় মারা যান যথাক্রমে ৮ ও ৪ জন৷ ঠিক এক বছর পর, অর্থাৎ ২০০২ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরায় জোড়া বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন তিন জন, আহত শতাধিক৷ সে বছরই ময়মনসিংহ শহরের চারটি সিনেমা হলে একযোগে ঘটানো বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন ১৯ জন, আহত দুই শতাধিক মানুষ৷
পরের বছরের একমাত্র হামলাটি হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে৷ এক মেলায় বোমা মেরে হত্যা করা হয় আট জনকে৷ মোটামুটি এক বছরের বিরতির পর হামলা চালানো হয় সিলেটের হযরত শাহ জালাল দরগা শরীফে৷ ২০০৪ সালের ১২ই জানুয়ারির সেই হামলায় ১০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছিলেন৷ সে বছরের মে মাসে আরেকটি হামলা হয়েছিল সিলেটে৷ তখনকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে চালানো সেই বোমা হামলায় আনোয়ার চৌধুরী বেঁচে গেলেও নিহত হয়েছিলেন দু'জন৷
নিজের জন্মভূমি সিলেট থেকে আনোয়ার চৌধুরী যেভাবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছিলেন, ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঠিক সেরকম ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছিলেন বলেই শেখ হাসিনা এখনো জীবিত৷ তখন তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রী৷ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সেদিন আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন৷ হঠাৎ শুরু হলো উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা৷ আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৩ জন নিহত এবং কয়েকশ' মানুষ আহত হয়েছিলেন সেই হামলায়৷
পরের হামলাগুলোতে নিহত-আহত বেশি না হলেও ভয়াবহতা কিছু কম ছিল না৷ ২০০৫ সালের ১লা জানুয়ারি বগুড়া ও নাটোরে মারা যায় তিন জন৷ ২০০৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কালো দিন৷ সেদিন হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচ জন নিহত হন৷
তবে অশুভ শক্তি তাদের ক্ষমতা আরো ভালোভাবে জানান দেয় ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট৷ সেদিন দেশের ৬৩টি জেলার পাঁচশ'রও বেশি স্থানে সিরিজ বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)৷
সে বছরের আরেকটি বোমা হামলার কথাও সবার মনে থাকার কথা৷ ১৪ই নভেম্বর বরিশালের ঝালকাঠিতে বোমা মেরে হত্যা করা হয় সহকারী জেলা জজ সোহেল খান ও জগন্নাথ পাঁড়েকে৷ পাঁচ দিন পর টাঙ্গাইলে আরেকটি হামলা, সে হামলায় মারা গিয়েছিলেন ন'জন৷ ২০০৬ সালের ৮ই ডিসেম্বর৷ আবার উদীচী কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলা৷ সেবারের ঘটনাস্থল নেত্রকোনা৷ ৮ জন নিহত আর ৪৮ জন আহত হয়েছিলেন সেখানে৷
১৯৯৯ থেকে ২০০৬ – এই সাত বছরের প্রায় সব হামলার সঙ্গেই জঙ্গি সম্পৃক্ততা প্রশ্নাতীত৷ কিছু হামলায় সাবেক বিএনপি সরকারের বা সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও আছে৷ এ সব হামলা এবং হামলায় নিহত-আহতরা শুধু সংখ্যা নয় – এ সব যেন দেশে জঙ্গিবাদের ক্রমোত্থানেরই ধারাবর্ণনা৷ পহেলা বৈশাখ, উদীচী, সিনেমা হল আর মেলায় হামলা চালিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে স্তব্ধ করার চেষ্টার মাঝে আর কি ইঙ্গিত থাকতে পারে? তাছাড়া দেশের অন্যতম বৃহৎ দল আওয়ামী লীগের নিকট অতীত এবং বর্তমান পরস্পরবিরোধিতা আর আপোষকামীতায় যত পূর্ণই থাক, তাদের উত্থানে একাত্তর, অস্তিত্বের নিয়ামকও একাত্তর৷ রাজনৈতিক সমাবেশ বা নেতাদের ওপর চালানো প্রতিটি হামলার শিকার শুধু এই দল কেন?
সেই দলই এখন ক্ষমতায়৷ সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, বিদেশি নাগরিক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং পুলিশ হত্যার পর সেই আওয়ামী লীগের নেতারাই জঙ্গিবাদ নিয়ে পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন৷ এত হামলা-হত্যার পরে ‘আইএস আছে কি নেই' প্রশ্নটাই তো হাস্যকর! হাস্যকর প্রশ্নে দায়িত্বহীন মন্তব্য করে নিজেদেরও হাস্যকর করে তুলছে আওয়ামী লীগ৷
বাংলাদেশে কি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ম্যাকডোনাল্ডস আছে? নেই তো! কিন্তু ম্যাকডোনাল্ডসে পাওয়া যায় এমন খাবার-দাবার, যেমন বার্গার, হটডগ কোকাকোলা, কফি – এ সব তো আছে বাংলাদেশে! সেভাবে আইএস এখনো হয়ত নেই, কিন্তু আইএস-এর ভাবশিষ্য জঙ্গি এবং জঙ্গিবাদের ধারক, পালক, পৃষ্ঠপোষক – সবই আছে৷ আছে আইএস-এর জন্মের বহু আগে থেকেই৷
কোথায় আছে?
কোথায় নেই, বলুন তো!
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাসা বাঁধছে জঙ্গিবাদ
একসময় বলা হতো, কওমি মাদ্রাসাগুলোই জঙ্গিবাদের কারখানা৷ সেই বাস্তবতা মুছে যায়নি৷ তাই বলে জঙ্গিবাদের প্রচার, প্রসারের উদ্যোগ শুধু মাদ্রাসাতে আটকে নেই৷ তাই যদি হতো তাহলে কি ব্লগার হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তারদের অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতো?
অভিজিৎ রায়, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ও অনন্ত বিজয় দাস হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটকদের সবাই যে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- এ সম্পর্কে গোয়েন্দারা নিশ্চিত৷ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও ইন্টারনেটে যোগাযোগ করে চালানো হচ্ছে জঙ্গি বাড়ানোর চেষ্টা৷
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ও সন্দেহের আবর্তে
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর শিক্ষার্থীদের মাঝেও জঙ্গি তৎপরতার প্রমাণ মিলছে৷ এমন তৎপরতার অভিযোগে কয়েকজনকে বহিষ্কারও করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তুপক্ষ৷
অনেক ধনীর দুলালও এই পথে....
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদেরও ভুলিয়েভালিয়ে দলে নিচ্ছে জঙ্গিরা৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য আগামীতে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার কথাও ভাবছেন৷ জঙ্গিবাদের চর্চা চলছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাখা হয়েছে নজরদারিতে।
আওয়ামী লীগেও?
আওয়ামী লীগের ঘরেও ঢুকে পড়ছে জঙ্গিবাদ? আগে প্রশ্নটা উড়িয়ে দেয়া যেত৷ আসিফ মহিউদ্দিনের হত্যাচেষ্টা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা এবং বর্তমান শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ভাতিজা সাদ আল-নাহিন গ্রেপ্তার হওয়ার পরও কেউ কেউ প্রশ্নটিকে তেমন আমল দেননি৷ মন্ত্রীর আত্মীয় বলে কথা! আইনের ফাঁক তো এমনিতেই আছে৷ ফলে সাদ আল-নাহিন জামিন পেয়ে গেলেন৷ তবে ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যায় জড়িত সন্দেহে আবারও গ্রেপ্তার হয়েছেন সাদ আল নাহিন৷ প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা হত্যা চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে নির্বিঘ্নে জামিন পেয়ে একেবারে হত্যা মামলারই আসামী! এবার বলুন, মন্ত্রীর পরিবারে জঙ্গি আছে, নাকি নেই?
সরকার বা আওয়ামী লীগ যা-ই বলুক, বাংলাদেশ সম্পর্কে কিন্তু ধীরে ধীরে একটা একটা স্পষ্ট ধারণা পেয়ে যাচ্ছে বহির্বিশ্ব৷ শুধু আন্তর্জাতিক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট'-এর বাংলাদেশ সম্পর্কিত একটি নিবন্ধের শিরোনামের কথা বলি৷ রাজনীতি, সমাজনীতি এবং সংষ্কৃতি বিষয়ক জাপানভিত্তিক ম্যাগাজিনটি গত বছর এক প্রতিবেদনের শিরোনামে লিখেছিল, ‘বাংলাদেশ: চিপ টি-শার্ট অ্যান্ড ফান্ডামেন্টালিজম'৷ মানে হালো, বাংলাদেশ: যেখানে টি-শার্ট আর মৌলবাদ খুব সস্তা৷
প্রতিবেদনের বেশ কিছু তথ্য এবং বিশ্লেষণেই ভিন্নমত আছে৷ প্রতিবেদনের ভেতরের বিষয়ে না গিয়ে শুধু শিরোনামের কথাই বলি৷ বাংলাদেশে টি-শার্টের চেয়ে জঙ্গিদের প্রাথমিক মতাদর্শ মৌলবাদ অনেক বেশি সহজলভ্য৷ টি-শার্টের উৎপাদন এবং ক্রয়-বিক্রয়ের স্থানগুলো মোটামুটি নির্দিষ্ট৷ মৌলবাদ প্রায় সর্বত্রগামী৷
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনের উপায় কী হতে পারে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷