বাংলাদেশের ফুটবলে সমস্যা কোথায়?
১৫ অক্টোবর ২০২১যে নেপাল, ভুটান কিংবা মালদ্বীপকে একসময় গুনে গুনে গোল দিত, তারাই এখন বাংলাদেশের কাছে অপ্রতিরোধ্য৷
কিন্তু কী কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ? এটা কি ফুটবলারদের সমস্যা? নাকি ফুটবল ফেডারেশন আর ক্লাবগুলোর? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷
শিক্ষিত ফুটবলারের অভাব
বাংলাদেশের একমাত্র উয়েফা প্রো লাইসেন্সধারী কোচ মারুফুল হক প্রায়ই বলেন, দেশে শিক্ষিত ফুটবলারের বড্ড অভাব৷ শিক্ষিত বলতে তিনি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার কথা বলেননি৷ আধুনিক ফুটবল শিক্ষা না থাকার বিষয়টিকে বুঝিয়েছেন৷
আসলেও তাই৷ ছোটবেলা থেকে আধুনিক ফুটবল জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠেছে এমন ফুটবলার দেশে নেই বললেই চলে৷ না থাকাটাই স্বাভাবিক৷ কারণ স্বাধীনতার এতো বছর পরও দেশে একটা সাধারণ মানের একাডেমি গড়ে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন৷ দু'বার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু পরিকল্পনা না থাকায় দুটোই বছর ঘুরতে না ঘুরতে বন্ধ হয়ে যায়৷
এরমধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছ থেকে লিজ নিয়ে অনেক জাঁকজমকভাবে সিলেট বিকেএসপিকে ২০১১ সালে একাডেমি হিসেবে চালু করে বাফুফে৷ ফিফার কাছ থেকে টাকাও পায়৷ অথচ সেই টাকার অভাব দেখিয়ে সেটা বন্ধও করে দেয় বাফুফে৷
এরপর ফর্টিজ গ্রুপের সহযোগিতায় ঢাকার বেরাইদে দ্বিতীয় দফায় একটি একাডেমি করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন৷ কিন্তু কী এক অজানা কারণে সেই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি৷
অথচ অনেক আগেই দেশে একাধিক একাডেমি গড়ে তোলা উচিত ছিলো বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি৷ তিনি বলেন, একাডেমি গড়তে না পারলে, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বিকেএসপিগুলোতে ভালো মানের কোচ দিয়ে বাছাই করা প্রতিভাবান কিশোর ফুটবলারদের গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে পারে বাফুফে৷
অথচ বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল কিংবা ভুটানের রয়েছে একাধিক ভালো মানের একাডেমি৷ সেসবের সুবিধা যে তারা হাতেনাতে পাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে এই দেশগুলোর ফলাফল তার প্রমাণ৷ সঙ্গে ফিফা ব়্যাংকিংতো আছেই৷
ফুটবলার উঠে আসার পথ সংকীর্ণ
একদিকে স্বীকৃত একাডেমি না থাকা, অন্যদিকে তরুণ ফুটবলার উঠে আসার যে কয়টি পথ দীর্ঘদিন চালু ছিল, সেগুলো প্রশস্ত তো হয়ইনি, উলটো আরও সংকীর্ণ হয়েছে৷ ফুটবলার তৈরির সূতিকাগারখ্যাত পাইওনিয়ার ফুটবল লিগ একেবারে অনিয়মিত৷ এই প্রতিযোগিতার সর্বশেষ আসর হয়েছে দুই বছর আগে, ২০১৯ সালে৷ অথচ এই পাইওনিয়ার ফুটবল লিগে অংশ নেয় ৭০ থেকে ৮০টি ক্লাবের প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার ক্ষুদে ফুটবলার, যারা ধাপে ধাপে উঠে আসে প্রিমিয়ার লিগে৷ পাইওনিয়ার লিগের মতো বাধ্যতামূলক টুর্নামেন্ট নিয়মিত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন দীর্ঘদিন এই প্রতিযোগিতায় কোচ হিসেবে কাজ করা কামাল বাবু৷
আর ঢাকার বাইরের জেলা কিংবা বিভাগীয় ফুটবল লিগের অবস্থা আরও করুণ৷ সংশ্লিষ্ট জেলার কর্তাদের মন চাইলেই কেবল মাঠে গড়ায় ফুটবল লিগ৷ এনিয়ে এবছর মার্চে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বাফুফে সভাপতি৷ লিগ নিয়মিত করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট জেলার বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটা ঘোষণাতেই আছে৷ আগের মতোই চলছে ঢাকার বাইরের ফুটবল৷ দু'একটি জেলায় শুরু হলেও, সেগুলোকে লিগ বলা রীতিমতো অন্যায়৷ কারণ কোনো রকমে দুচারটি দল গড়ে অনেকটা পিকনিক মুডে শেষ করা হয় খেলাগুলো৷
স্পন্সর থাকার পরও ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে সর্বাধিক ৪৫টি জেলায় হয়েছিল ফুটবল লিগ৷ এরপর ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দেশের কোনো জেলাতেই ফুটবল হয়নি৷ তবে ব্যতিক্রম ছিলো ২০১৮ সাল৷ বাফুফে এবং সাইফ পাওয়ারটেক জেলাগুলোকে টাকা দেয়ায় সেবছর সর্বাধিক ৫২টি জেলায় হয়েছিলো ফুটবল লিগ৷ এরপর আবার ফিরেছে আগের রূপে৷ অর্থাৎ বেশিরভাগ জেলাতেই ঠিকমতো হচ্ছে না ফুটবল লিগ৷
এ নিয়ে জেলার ফুটবল কর্তাদের ওপর রীতিমতো ক্ষুদ্ধ খোদ বাফুফের কর্মকতারা৷ ঢাকা থেকে জেলা লিগগুলো তদারকি করেন ফুটবল ফেডারেশনের এক্সিকিউটিভ মোজ্জামেল হোসেন মিঠু৷ তিনি বলেন, ফেডারেশন থেকে টাকা নেওয়ার পরও লিগ বা টুর্নামেন্টের আয়োজন করে না এমন জেলার সংখ্যা অনেক৷ এরমধ্যে কক্সবাজার আর নারায়ণগঞ্জের কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন৷ মিঠু বলেন, গত সাত বছরে কোন ফুটবল লিগ করেনি কক্সবাজার জেলা ফুটবল এসোসিয়েশন৷
নিয়মিত কোচ বদল
ফুটবল কোচের চাকরি সবসময়ই অনিশ্চয়তায় ভরা, এটা মোটামুটি সবারই জানা৷ তবে বাংলাদেশের মতো অনিশ্চয়তা বোধহয় পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই৷ কারণ স্বাধীনতা পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪৮ জন কোচ বদল করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন৷ আর কাজী মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের গত ১৩ বছরের শাসনামলে ২০ জন কোচ পরিবর্তন করেছে বাফুফে৷ এরমধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যবান ইংল্যান্ডের জেমি ডে৷ ২০১৮ সালের মে থেকে এবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন বছরের বেশি সময় কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি৷ এর বাইরে এক থেকে পাঁচ মাস করেছেন এমন কোচও আছেন বেশ কয়েকজন৷
গত ৫০ বছরে ইউরোপ, ল্যাটিন, স্প্যানিশ এবং এশিয়ান ঘরানার কোচের স্পর্শ পেয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কোনো কোচকেই সেভাবে সময় না দেয়ার কারণেই বাংলাদেশের খেলার ধরন তৈরি হয়নি বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ হাসানুজ্জান খান বাবলু৷ তিনি বলেন, এরফলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কোচের কৌশলের পরীক্ষার শিকার হচ্ছেন দেশের ফুটবলাররা৷ উপমহাদেশের অন্যদেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার এটিও অন্যতম কারণ বলে জানান জাতীয় দলের অধিনায়ক বাবলু৷
মানসম্পন্ন মাঠের অভাব
বাংলাদেশের ফুটবলের প্রাণভমরা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম৷ কিন্তু সেটাও কি আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন? উত্তর পুরোপুরি না৷ তারপরও এই একটি মাঠ প্রিমিয়ার লিগের ১৩টি ক্লাবের মধ্যে সাতটির হোম ভেন্যু৷ এই তথ্য থেকেই পরিষ্কার হয় বাংলাদেশে ফুটবল মাঠের সংকট কতোটা প্রকট৷ ভালো খেলোয়াড় তৈরির জন্য ভালো মানের কোচের পাশাপাশি ভালো মাঠের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘দেশের বাইরে খেলতে গেলে বুঝতে পারি আমরা কতটা খারাপ মাঠে ফুটবল খেলি৷’’ বিষয়টি ম্যাচেও প্রতিপক্ষের সঙ্গে পার্থক্য গড়ে দেয় বলে মনে করেন মামুনুল৷
ক্লাবগুলোর বয়সভিত্তিক দল না থাকা
খেলোয়াড় তৈরির পাইপ লাইন যদি হয় বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা, তবে সেই জায়গাটাতে এখনও সেভাবে কাজই শুরু হয়নি বাংলাদেশের ফুটবলে৷ সাইফ স্পোর্টিং কিংবা বসুন্ধরা কিংস ছাড়া কোনো ক্লাবেরই বয়সভিত্তিক কোনো দল নেই৷ এমনকি আবাহনী-মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এই দিকটির গুরুত্বই অনুধাবন করতে পারেনি৷ অথচ ক্লাবের বয়স ভিত্তিক দল থাকলে লাভবান হয় নিজেরাই৷ কম খরচে গড়ে তোলা ফুটবলারকে নিজেদের সিনিয়র দলে খেলাতে পারেন অনায়াসে৷ যা করে থাকে, পৃথিবীর সব পেশাদার ক্লাব৷
এ বিষয়ে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের হেড কোচ হিসেবে কাজ করা সাইফুল বারী টিটু বলেন, এএফসির ভিশন এশিয়া প্রকল্প কাজে লাগিয়ে ক্লাবগুলোর জন্য বয়সভিত্তিক ফুটবল বাধ্যতামূলক করেছে ভারত৷ পরে ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর আইএসএলের ক্লাবগুলোর জন্যও বয়স ভিত্তিক দল রাখা বাধ্যতামূলক করেছে অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন৷ যার ফলাফল এখন পেতে শুরু করেছে ভারত৷ বিশেষ করে এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতীয় পাঁচ থেকে ছয়জন আছেন যারা ক্লাবগুলোর বয়স ভিত্তিক দল থেকে উঠে এসেছেন৷
শিক্ষিত কোচের অভাব
গত দুতিন বছর মাঝে মাঝেই কোচেস কোর্স পরিচালনা করছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন৷ এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ৷ কিন্তু এসব কোর্স করা কোচদের কতজন কাজ করছেন দেশের তৃণমূল ফুটবলের সঙ্গে, সেটা একটা গবেষণার বিষয়৷
তবে দেশে যে ভালো মানের কোচের অভাব তা স্পষ্ট হয় প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর ডাগ আউটের দিকে তাকালে৷ ১৩টি ক্লাবের মধ্যে শুধুমাত্র পাঁচটি ক্লাবে আছেন স্থানীয় কোচ৷ বাকি সবাই আস্থা রাখছে বিদেশি কোচদের ওপর৷
কিন্তু এটা দেশের ফুটবলের জন্য ভালো ইঙ্গিত নয় বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক৷ প্রয়োজনে বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়ে প্রতিটি জেলায় একজন বা একাধিক ভালো মানের কোচ নিয়োগের জন্য বাফুফেকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি৷ যাদের কাজ হবে, জেলার প্রতিটি থানার খেলাগুলো পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রতিভাবান ভালো খেলোয়াড় চোখে পড়লে তাদের জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা৷ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলার স্থানীয় কোচদের ভুলত্রুটি সংশোধন করে দেয়া৷