পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার সুযোগ প্রসারিত
২৫ জুন ২০২০বাঙালি যেখানেই বাস করুক, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি তার অধিকার ও অনুরাগ কমার কথা নয়৷ বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস বলে সাহিত্য নিয়ে আদানপ্রদান বহুদিনের৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর সেই আশির দশক থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে ওপার বাংলার সাহিত্য নিয়ে চর্চা শুরু হয়৷ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের সাহিত্য৷ এই সুযোগ কলকাতা, যাদবপুর, নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পর আরো প্রসারিত করতে চলেছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়৷
সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত নীতিনির্ধারক কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বাংলাদেশের সাহিত্য স্নাতকোত্তর স্তরের পঠনপাঠনে ব্যাপক আকারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে৷ মাস্টার ডিগ্রিতে চতুর্থ সেমিস্টারের বিশেষ পত্র হিসেবে বাংলাদেশের সাহিত্য পড়তে পারবেন ছাত্রছাত্রীরা৷ কোন সাহিত্যিকের লেখা থাকছে এই পাঠক্রমে? আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কালজয়ী উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’, হাসান আজিজুল হকের গল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ‘হুলিয়া’ যেমন থাকছে, তেমনই পড়ানো হবে সৈয়দ শামসুল হকের নাটক ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’৷ শুধু সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এই পাঠক্রম যে বছর চূড়ান্ত হয়েছে, সেই বছর বাংলাদেশে তাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী পালন করছে৷ অর্থাৎ মুজিববর্ষেই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বাঙালি রাষ্ট্রনেতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী৷ অবশ্যই থাকছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস৷ জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি', মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ৭১' পড়ার সুযোগ পাবেন ছাত্রছাত্রীরা৷
সাহিত্যের ক্ষেত্রে অতীতের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত নবীন লেখকদের রচনা উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষক থেকে শিক্ষাবিদরা৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আশিস রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এটা অসাধারণ উদ্যোগ৷ এর ফলে এপার বাংলার ছাত্রছাত্রীরা বাংলাদেশকে আরো নিবিড়ভাবে জানতে পারবেন৷ এটা নিয়ে চর্চা করতে পারবেন৷’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবশ্যিক পত্র হিসেবে পড়ানো হয় বাংলাদেশের সাহিত্য৷ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে ওপার বাংলা সাহিত্য পড়ার সুযোগ রয়েছে৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান বরেন্দু মণ্ডল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশের সাহিত্য বেশি করে পড়া উচিত৷ তাহলে তাদের সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা তৈরি হবে৷ শুধু প্রতিবেশী দেশ নয়, ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, ওড়িশা— এসব প্রতিবেশী রাজ্যের সাহিত্যও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত৷’
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের সাহিত্য পাঠক্রমে রয়েছে৷ সে কথা উল্লেখ করে প্রবীণ শিক্ষাবিদ বলেন, ‘আমাদের সাহিত্য মানে অখণ্ড বাংলার সাহিত্য৷ তাতে সমগ্র বাঙালির উত্তরাধিকার৷ সে তিনি ভারত-বাংলাদেশ থাকুন কিংবা ইউরোপ-আমেরিকায়৷ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যের চর্চা করলে এই উত্তরাধিকার সম্পর্কে এখনকার প্রজন্ম আরো সচেতন হবে৷ যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য পড়বেন, আশা করা যায় তাঁরা নিজেদের বৃত্তে এই চর্চা ছড়িয়ে দেবেন৷’
আরো একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেশী দেশের সাহিত্যচর্চা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাহিত্যিক অমর মিত্র৷ তাঁর বক্তব্য, ‘ইংরেজি সাহিত্য যদি ছেলেমেয়েদের পড়ানো হয়, তাহলে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ কেন পাঠ্যসূচিতে থাকবেন না৷ একইসঙ্গে জরুরি দুই দেশের মধ্যে আদান-প্রদান৷ আমরা যেমন এখানে পড়ব, তেমনই বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকে জায়গা করে দিতে হবে৷ ওপার বাংলার ছাত্রছাত্রীরা এপারের সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা গড়ে তুলতে পারবে৷’ কিন্তু শুধু প্রাতিষ্ঠানিক চর্চাতেই কি দুই বাংলার মানুষের পরস্পরের প্রতি ধারণা উন্নত করা সম্ভব? সাহিত্যিকের মতে, ‘সাহিত্য বৃহত্তর পাঠকসমাজেরই বিষয়৷ প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্যে শুধু আবদ্ধ নয়৷ যে কোনো ভাষার সাহিত্য ব্যাপকভাবে চর্চিত হোক, এটাই কাম্য৷ তাতে চেতনা বাড়বে৷ পরস্পরকে জানা-বোঝার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে৷’