বাকস্বাধীনতার জন্য লড়ছেন বাদাউয়ি
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫‘‘ওকে নিয়ে আমি অত্যন্ত শঙ্কিত,'' ক্যানাডা থেকে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন এনসাফ হায়দার৷ তবে শুধু তিনিই নন, রাইফ বাদাউয়ির জন্য গোটা বিশ্ব আজ আকুল৷ জানুয়ারির ৯ তারিখ বাদাউয়িকে যখন প্রথম পঞ্চাশ ঘা বেত মারা হয়েছিল, তখন থেকেই পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমে তাঁর বিষয়টি স্থান পেয়েছে৷ হয়েছে গণবিক্ষোভ, চলেছে গণপ্রতিবাদের ঢল৷ কিন্তু এতকিছুর পরেও মুক্তি পাননি উদারপন্থি এই ব্লগার৷
এ বছর প্রথমবারের মতো ডিডাব্লিউ-র ‘ফ্রিডম ও স্পিচ অ্যাওয়ার্ড' দেওয়া হচ্ছে৷ আর এই পুরস্কার পাচ্ছেন রাইফ বাদাউয়ি৷ এ সম্পর্কে জানতে পেরে স্ত্রী এনসাফ হায়দার ডয়চে ভেলের বলেন, ‘‘রাইফ যে এখনো কারাগারে রয়েছেন, এটা খুবই লজ্জার বিষয়৷ তাও আবার এমন এক সময়ে, যখন সৌদি আরব ‘ইসলামিক স্টেট'-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে, যারা মানবাধিকারের পরোয়া করে না৷ ‘‘ডিডাব্লিউ-র ফ্রিডম অফ স্পিচ অ্যাওয়ার্ড সৌদি প্রশাসনকে অত্যন্ত স্পষ্ট এক বার্তা পাঠাচ্ছে৷ তাই এ সাহায্যের জন্য আমি ডয়চে ভেলের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ৷''
জন্ম ও বড় হওয়া
১৩ই জানুয়ারি ১৯৮৪ সালে সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলে আল খোবার নামের একটা ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন ব্লগার রাইফ বাদাউয়ি৷ তিনি এবং বড় বোন সমর – দু'জনেই মাত্র সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন৷ কিন্তু এই অপারগতা প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়নি৷ সৌদি আরবে নারী স্বাধীনতা নিয়ে দীর্ঘ একটা সময় কাজ করেছেন সমর৷ ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে ‘আন্তর্জাতিক সাহসী নারী'-র খেতাবও জয় করেন তিনি৷ বাদাউয়ির জীবনে তাই সমরেরও একটি প্রভাব রয়েছে, প্রতিবাদের ভাষা তিনি শিখেছেন নিজ পরিবার থেকেই৷
মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে অবস্থান
রাইফ বাদাউয়ি বেশ কয়েক বছর ধরে নিজের দেশে মত প্রকাশের অধিকারের সপক্ষে সংগ্রাম চালাচ্ছেন৷ ‘ফ্রি সৌদি লিবারালস' বা ‘মুক্ত সৌদি উদারপন্থি' নামের এক ওয়েবসাইটে তিনি সৌদি আরবে রাজনৈতিক ও সামাজিক ত্রুটিগুলি তুলে ধরছেন৷ তিনি ধর্মীয় পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে শ্লেষাত্মক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, দেশের এক বড় বিশ্ববিদ্যালয়কে সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন – এমনকি ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস সম্পর্কেও লিখেছেন৷ বলা বাহুল্য, সৌদি আরবে এই উৎসব পালন নিষিদ্ধ৷
বারংবার গ্রেপ্তার, নানা অভিযোগ
ইসলামের অবমাননাকারী এক ‘ইলেকট্রনিক পাতা' তৈরির অভিযোগে ২০০৮ সালে বাদাউয়িকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয়৷ তারপর তিনি কয়েক মাসের জন্য দেশত্যাগ করেন৷ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ প্রত্যাহার করার পর তিনি আবার দেশে ফেরেন৷ ২০০৯ সালে সৌদি সরকার তাঁর দেশ ছাড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে৷ ২০১২ সালের ১৭ই জুন কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ডিসেম্বর মাসে আদালতে পেশ করে৷ বাদাউয়ির বিরুদ্ধে অভিযোগ – তিনি তাঁর ওয়েবসাইটে ইসলামি ধর্মীয় নেতাদের অবমাননা করেছেন৷
‘কিস্তিতে হত্যা'
এর পর এক উচ্চতর আদালত বাদাউয়ির বিরুদ্ধে স্বধর্ম ত্যাগের অভিযোগ এনেছিল, সৌদি আরবে যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে৷ তাঁরই একটি উক্তিকে এই অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তিনি নাকি মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও নাস্তিকদের সমান হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷ তবে পরে এই অভিযোগ আবার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়৷ ২০১৩ সালে বাদাউয়ির স্ত্রী এনসাফ হায়দার তাঁদের তিন সন্তান সহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং ক্যানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় পান৷
১০ বছরের কারাদণ্ড, ১,০০০ বেত্রাঘাত
২০১৪ সালের মে মাসে এক সৌদি আদালত ৩১ বছর বয়স্ক ব্লগার রাইফ বাদাউয়ির বিরুদ্ধে রায় দায়৷ তাঁর শাস্তির তালিকায় রয়েছে ১,০০০ বেত্রাঘাত, ১০ বছরের কারাদণ্ড ও প্রায় ২ লক্ষ ইউরো জরিমানা৷ গত ৯ই জানুয়ারি তাঁকে ‘প্রথম কিস্তিতে' প্রকাশ্যে ৫০ বার বেত্রাঘাত করা হয়৷ তার পর থেকে অবশ্য স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে শাস্তির দিনক্ষণ বার বার পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷
বাদাউয়ি মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে গেলেও মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, ২০ সপ্তাহ ধরে ৫০টি করে বেত্রাঘাত তাঁকে ধাপে ধাপে কষ্টকর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে৷ জার্মানির সবুজ দলের রাজনৈতিক নেতা টম ক্যোনিশ একে ‘কিস্তিতে হত্যা' হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক ভাল্টার স্টাইনমায়ার বাদাউয়ির বিরুদ্ধে শাস্তিকে ‘নৃশংস, ভুল, অন্যায় ও সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ' হিসেবে মনে করেন৷