বাঙালি মুসলমানের মন কি বদলেছে?
৩০ অক্টোবর ২০২০‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নামের আহমদ ছফা রচিত প্রবন্ধসংকলনটি প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে৷ তবে নাম প্রবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৭৬-এ৷ প্রবন্ধটিতে তিনি বাঙালি মুসলমানের নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন৷ সাহিত্য ও ইতিহাস ঘেঁটে খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, বাঙালি মুসলমানরা কেন পিছিয়ে৷
তিনি এই পশ্চাৎপদতার কারণ হিসেবে বাঙালি হওয়া বা মুসলমান হওয়াকে নয়, বরং এই অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘ একটা সময় যে বৈষম্যের মধ্য দিয়ে গেছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, সব কিছুকেই এর জন্য দায়ী করেছেন৷
ছফা লিখেছিলেন, বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই ভয় করে৷ ভাসাভাসা জ্ঞান থাকলেও, ভাব করে যেন অনেক জেনে গেছে৷ তিনি আরো লিখেছেন, যে নিজের ভালমন্দ নিজে নিরূপণ করতে পারে না, অপরের পরামর্শ ও শোনা কথায় কাজকর্ম করে, তাকে ‘‘খোলা থেকে আগুনে কিংবা আগুন থেকে খোলায়, এইভাবে পর্যায়ক্রমে লাফ দিতেই হয়৷’’ তো আগুনে যে তারা ঝাঁপাঝাঁপি করেন তা তো লালমনিরহাটের শহীদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মারার ঘটনাতেই প্রমাণিত হয়৷ কিন্তু ঐ যে ছফা বলেছিলেন, এদের চিন্তা ও মননের গভীরতা বাড়েনি, তারা বাইরের কথা শোনেন, তো তারাও কারো কথা শুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন৷ ঝাঁপিয়ে পড়ে জুয়েলকে নিঃশেষ করেছেন, অঙ্গার বানিয়েছেন৷ কেউ একজন নাকি আগুন লাগানোর বিষয়টি লাইভও করেছেন৷ হাজার হাজার মানুষ তাতে লাইকও দিয়েছেন৷ তাহলে এমনই কি এখনকার বাঙালি মুসলমানের মন?
ছফার পরামর্শ ছিল, বাঙালি মুসলমানদের মন যদি নির্মোহভাবে জানা যায়, তাহলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা উপায় বেরিয়ে আসতে পারে৷ তো সেই চেষ্টা খুব যে গভীরভাবে হয়েছে তা চোখে পড়ে না৷
উলটো আরব সমাজের মুসলমানদের আচার, পোশাক ও পরামর্শ নিতে পিছপা হন না বাঙালি মুসলমানরা৷ বিশেষ করে সৌদি আরব ও মিশরে পড়াশোনা করা কিংবা কাজের জন্য থাকার সুবাদে অনেকেই সেখানকার সমাজের ধারণা নিয়ে ফেরত আসেন৷ সেগুলোকেই ‘পবিত্র’ জ্ঞান করেন৷ সেই ধারণাই সমাজে ছড়িয়ে দেন৷ মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব তুরস্কের দিকে ঝুঁকে পড়ার যে প্রবণতা, সেখানেও সায় রয়েছে বাঙালি মুসলমানদের অনেকেরই৷ তুরস্কের এর্দোয়ানকে তারা ভালোবাসেন৷ কারণ, তিনি ‘মুসলমানদের পক্ষে' আওয়াজ তোলেন৷
কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের সমাজের দিকে কতটা তাকান? তারা সিরিয়া, লিবিয়া, প্যালেস্টাইন নিয়ে সোচ্চার৷ অবশ্যই যে-কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে, নিরপরাধ মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটা মানবিক ধর্ম৷ কিন্তু তারা এটা কি ভাবেন আরব দেশগুলো বা এর্দোয়ানরা বাঙালি মুসলমানদের জন্য কতটা সোচ্চার? এখানে পড়ে থাকা রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকারের ব্যাপারে কতটা সোচ্চার?
বাঙালি মুসলমানরাই বা তাদের সমাজে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কতটা কথা বলেন? তাদের সমাজে শিশুরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় ধর্ষণের শিকার হন, যৌন নিপীড়নের শিকার হন, সেজন্য তারা দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কতটা আওয়াজ তোলেন? ছফা বলেছিলেন, ‘‘সুবিধার কথা হলো, নিজের পঙ্গুত্বের জন্য সবসময়ই দায়ী করবার মতো কাউকে না কাউকে পেয়ে যায়৷’’ তো ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের জন্যও আমরা বারবার তাদের দেখি নির্যাতনের শিকারদের ওপরেই চড়ে বসতে৷ নিরীহ পোশাককে দায়ী করতে, যেখানে ধর্ষকদের আচরণ বলছে, পোশাক বা বয়সের তোয়াক্কা করেন না তারা, তাদের মানসিকতাই দায়ী এর জন্য৷ তো কেন এমন করেন তারা? কারণ বলশালী অপর পক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলার চাইতে নিরীহ পক্ষের ওপর চেপে বসা সহজ৷
বাঙালি মুসলমানরা তাদের সমাজে থাকা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকারের ব্যাপারে কতটা সোচ্চার? এবারো দুর্গাপূজায় প্রতিমা ভাঙচুরের খবর মিলেছে৷ প্রতিমা বা মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়৷ স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘর-বাড়ি ধানের গোলা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বহুবার৷
এই যে রামু বৌদ্ধমন্দিরে হামলার, কিংবা সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার খবরে ভাঙচুরে মেতে ওঠা মানুষগুলো কি আহমদ ছফার বিশ্লেষণকে আজও সত্য প্রমাণ করেন না?
বাংলাদেশে প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমান৷ তাই ধরেই নেয়া যায়, দেশের ৯০ ভাগ দুর্নীতি মুসলমানরাই করেন৷ ঘুস খান, মিথ্যা বলেন, চুরি করেন, অপরের ক্ষতি করেন৷ তো বাঙালি মুসলমানরা সেসব নিয়ে কথা বলেন? এই যে সমাজে এত অসঙ্গতি এসব বিষয়ে বাঙালি মুসলমানের মন কেন কাঁদে না? অথচ তাদের অনেকের মন কাঁদে সেই কতদূরের চেচেন যুবকের জন্য যে দিনে দুপুরে গলা কেটে মানুষ হত্যা করে৷ এসব কর্মকাণ্ড সাধারণ ইউরোপীয় বা পশ্চিমাবিশ্বের নাগরিকদের মনে কী প্রভাব ফেলে, এসব ভেবেছেন কি? এই যে কঠিন বিভেদ, এর ফলাফল কী তা কি ভেবে দেখেছেন?
কেন তারা চিন্তা করেন না, যুবকটি যে কাণ্ড করেছে, সেজন্য ইউরোপে বসবাস করা আরো লাখো মুসলমান, যারা সেখানে সংখ্যালঘু, তারা বিপদে পড়েন৷ এই যে সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল পাড়ি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে আসেন উন্নত জীবনের আশায়, দেশে ফেলে আসা প্রিয়জনদের আরেকটু ভালো রাখার আশায়, যাদের পাঠানো অর্থে দেশের অর্থনীতি টিকে আছে, তাদের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলে এসব হত্যাকাণ্ড৷
সেইসঙ্গে ইসলামভীতির যে অপরাজনৈতিক চর্চা সারাবিশ্বে হয়, সেই আগুনে আরো ঘি ঢালা হয়৷ অপরাজনীতি সবসময় অপর পক্ষের জন্য ফাঁদ পেতে রাখে৷ এসব হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়ে সেসব অপচর্চার ফাঁদে পা দেন এই মুসলিমরাই৷ তাই বলে কি নিজেদের বিশ্বাসের ওপর, নবীর ওপর আঘাত এলে প্রতিবাদ করতে পারবে না মুসলিমরা? শুধু মুসলিম নন, সংক্ষুব্ধ যে কারো প্রতিবাদ জানাবার অধিকার আছে৷ কিন্তু তার শান্তিপূর্ণ উপায় নেই কি?
আর বাঙালি মুসলমান বা বাঙালি জাতি এখনো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে অতটা উন্নত বা শক্তিশালী নয় যে তাদের কথা শুনবে বিশ্ব৷ বলাই বাহুল্য, গেল দুই আড়াই দশকে এ ভূখণ্ডের মানুষ আগের চেয়ে প্রযুক্তির বিকাশ অনেক বেশি দেখেছেন৷ এই প্রযুক্তির সুবিধাও নিয়েছেন৷ কিন্তু একে হৃদয়ঙ্গম করা, এর পেছনের দর্শন ও যুক্তিগুলো জ্ঞান দিয়ে ভাবার চেষ্টার কাজটি কতটা করা হয়েছে? ৭৬ সালে ছফা বলেছিলেন, তা করা হয়নি৷ তা করা না হলে একটি জাতি উন্নত হবে না, সেটিও বলেছিলেন তিনি৷ তো আজও প্রযুক্তির বিকাশের জন্য আমাদের পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়৷ তাই সেই জ্ঞানকে বোঝার চেষ্টার ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে বাঙালিরা খুব বেশি যে এগোয়নি, সে সত্য এখনো খাটে৷ ছফা সে কারণেই বলেছেন, নিজেদের বুঝতে হবে৷ ঘৃণা নয়, ভালোবাসা দিয়ে একটা সাম্য ও সহমর্মিতার সমাজ যেখানে সবার অধিকার সংরক্ষিত, এমন একটি সমাজ গঠন করায় মনযোগী হতে হবে৷ প্রশ্ন হলো, যে গাঢ় মায়াজাল বাঙালি মুসলমানের মনে বিস্তৃত বলেছিলেন আহমদ ছফা, সেই জাল ভেদ করে কি বেরিয়ে আসতে পারবেন তারা?