বাঙালির জীবনে আজও প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ
১৫ মে ২০১১রবীন্দ্র অনুরাগীরা হিসেব করে দেখেছেন, তাঁর লেখা এবং সুর করা প্রায় সাড়ে তিন হাজার গানের মধ্যে খুব বেশি হলে একশো থেকে দেড়শোটি গান মাত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাওয়া হয়৷ তাঁর লেখা প্রবন্ধ বা দীর্ঘ কবিতা সচরাচর কেউ পড়ে না৷ আর রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনতো তাঁর হাতে গড়া শান্তিনিকেতনেই আজ একঘরে৷ তার উপর এই সাধর্শতবর্ষের হুজুগে তাঁর সৃষ্টি নিয়ে যেমন সব এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয়েছে তা আরও বেদনাদায়ক৷ যেমন বলছিলেন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার, একান্ত রবীন্দ্র অনুরাগী পার্থ ঘোষ৷
তাঁর কথায়, ‘‘এই যে বিবর্তনটা হচ্ছে এখন, তাতে রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক করা হচ্ছে৷ যেমন এখন তাঁর কবিতার সঙ্গে বাজনা দিচ্ছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে৷ আমি (এটা) সমর্থন করি না৷ আবৃত্তি করতে গেলে, আবৃত্তি নিজেই সুন্দর, তাকে সুন্দর করার জন্যে মিউজিকের দরকার হয় না৷ নাটকে দরকার পড়ে৷ আমার এখনও বিশ্বাস, আমি আবৃত্তি করব, তাতে একটা মুহূর্তকে আমি নিজেই ঘনিয়ে তুলব আমার কন্ঠে৷ তার জন্যে বেহালার সুর বা সেতারের বাজনা বা ইলেকট্রনিক বাজনা দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রকাশ করব, তাতে আমি বিশ্বাস করি না৷''
পার্থ ঘোষের সহধর্মিনী, বাচিক শিল্পী হিসেবে যিনি নিজেও স্বনামধন্য, সেই গৌরী ঘোষ রীতিমত উদ্বিগ্ন যে কেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই অকারণ টানাপোড়েন৷ তিনি বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা এবং ছড়া, তাতে সুর দিয়ে, তাতে নতুন করে সুরারোপ করে, সেগুলো গান বলে রেকর্ড হচ্ছে৷ এও তো দেখছি আমরা৷ কেন? রবীন্দ্রনাথের এত অজস্র গান আছে, সেগুলোই আগে লোকের কাছে তুলে ধরা হোক না৷ স্বরলিপি অনুযায়ী গেয়ে৷ তাছাড়াও, এই যে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে বিভিন্ন ... রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই পাশ্চাত্য সংগীতের সুর, অন্যান্য প্রাদেশিক সংগীতের সুর, সব দিয়ে নিজের গানকে সমৃদ্ধ করেছিলেন৷ সেখানে এখনকার ফিল্মে যে গান ব্যবহার করা হয়েছে, আমাদের কাছে এটা অশ্লীল মনে হয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথের গান - পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, সেটিকে এমন করে.. তিনি নিজেও শক্তিমান গায়ক, সুরকার, তিনি তার সঙ্গে হু লাল্লা হু লাল্লা দিয়ে গানটাকে অন্যভাবে...৷ ছবি অসাধারণ হল৷ গানটাও কিছু মানুষের কাছে জনপ্রিয় হল৷ কিন্তু আমরা ভাবতে পারি না, কেন৷''
তবে সব পরীক্ষাই বিফল হয় না, বরং কিছু প্রচেষ্টা রবীন্দ্রনাথকে যেন আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলে৷ কয়েক বছর আগে আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের বন্দিদের দিয়ে বাল্মিকী প্রতিভা নৃত্যনাট্য করিয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়৷ আশ্চর্যজনক ভাবে দাগি অপরাধীদের অনেককেই বদলে দিয়েছিল সেই অভিজ্ঞতা৷ অলকানন্দার কথায়, ‘‘আমি যখন বাল্মিকী প্রতিভা করতে শুরু করেছি, ওটা কিন্তু আড়াই বছর আগে৷ ওটা করতে গিয়ে আমি লক্ষ্য করলাম যে এই নাচের মধ্যে দিয়ে, ছন্দের মধ্যে দিয়ে ওদের নিজেদের মধ্যে একটা পরিবর্তন ভিতর থেকে হচ্ছিল৷ সেটা হয়তো মানুষ ওদের শিল্পী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য৷ ওরা যে দোষ করেছে, তার জন্য ওরা শাস্তি পাচ্ছে৷ আবার যে ভাল কাজ করছে, তার স্বীকৃতিও পাচ্ছে৷ ওদের যেন ভাল হতে ইচ্ছে হল৷ আমার মনে হল ওরা যেন সবাই দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মিকী হচ্ছে৷''
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে নতুন যে প্রযোজনার কাজ শুরু করেছেন অলকানন্দা রায়, তার প্রস্তাব এসেছে ওই কারাগারের বন্দিদের থেকেই, যাদের অনেকেই তাঁকে এখন মা বলে ডাকেন৷ তিনি জানান, ‘‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদটাকে ডান্স ড্রামা ফর্মে৷ কবিতা অবলম্বনে, মহাভারতের কাহিনি নিয়ে, কর্ণের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত৷ তবে কর্ণ কুন্তীকে নিয়েই৷ বাল্মিকী প্রতিভা যেমন, আমি রবীন্দ্রনাথের ভাবনা থেকে এক বিন্দু সরিনি৷''
তবে একটা কথা অনস্বীকার্য যে সেদিন হতে শত বর্ষ পরে নয়, তারও আরও পঞ্চাশ বছর পরে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় অতি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ৷ সেটা নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক দিক৷
প্রতিবেদন: শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক