কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব
১১ নভেম্বর ২০১৩লোক দেখানো সৌজন্য নয়, বরং যথেষ্ট আন্তরিক শোনাচ্ছিল জয়া ভাদুড়ি বচ্চনের গলা, যখন তিনি ধন্যবাদ জানালেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে কলকাতায় আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য৷ খুশিতে ঝলমলে জয়া বললেন, তাঁর বহু পুরনো সহকর্মীর সঙ্গে ৩০ বছর পর দেখা হচ্ছে৷ এতদিন সে সুযোগ হয়নি৷ তার পরেই মঞ্চে অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান আর কমল হাসানদের সঙ্গে এক সারিতে বসে থাকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের দিকে ফিরে জয়া বললেন, সাবিত্রীদি, সেই ‘ধন্যি মেয়ে'-র পরে আবার?
যাকে ‘রিডিং বিটুইন দ্য লাইনস' বলা হয়, জয়া ভাদুড়ির এই বক্তব্যে যদি সেটা করার চেষ্টা করেন, তাহলে দেখবেন, এটা আসলে বাংলার অত্যন্ত প্রতিভাধর এবং জনপ্রিয় এক অভিনেত্রীর খেদোক্তি৷ যিনি ভারতীয় সিনেমার পয়লা নম্বর আইকন অমিতাভ বচ্চনকে বিয়ে করার সূত্রে প্রবাসী হওয়ার পর হিন্দি ছবিতেও নিজের অভিনয় দক্ষতা প্রমাণ করেছেন, তাঁর গোপন দুঃখ হয়ত এটাই যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনোদিন চলচ্চিত্র উৎসবে হাজির থাকার আমন্ত্রণ তিনি পাননি৷ অথচ এই শহরে সেই ভাষাতেই সবাই কথা বলে, যেটা তাঁর মাতৃভাষা৷
পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, যিনি সংস্কৃতিমনস্ক বলে পরিচিত ছিলেন, তিনি বাঙালি সেন্টিমেন্টের এই জায়গাটা কোনোদিন ধরতে পারেননি, কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি পেরেছেন৷ তাই এই ১৯তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে সম্বর্ধনা জানানো হবে বাংলার অভিনেত্রী পঞ্চকন্যাকে৷ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, সুস্মিতা সেন, বিপাশা বসু, রানী মুখার্জি এবং কঙ্কনা সেনশর্মা সম্বর্ধিত হবেন তাঁদের নিজেদের রাজ্যে৷
রবিবার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলাকালীন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে বসে দেখতে পান, অভিনেত্রী-পরিচালিকা অপর্ণা সেন বসে রয়েছেন দর্শকাসনে৷ দেখেই চঞ্চল হয়ে ওঠেন তিনি৷ প্রথমে বলেন তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তরের আমলাদের৷ তারপর তাঁদের ভরসায় না থেকে নিজেই দ্রুত পায়ে মঞ্চ থেকে নেমে যান৷ দর্শক আসন থেকে হাত ধরে অপর্ণা সেনকে টেনে নেন, এনে বসান মঞ্চে৷ তখন কে বলবে, কয়েক মাস আগে এই অপর্ণা সেনই একটি ধর্ষণের ঘটনার প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন রাজ্য সরকার সম্পর্কে এবং সেই সূত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর মনান্তরও হয়েছিল৷
কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসব যে মুষ্টিমেয় কিছু চলচ্চিত্রপ্রেমী বুদ্ধিজীবীর কুক্ষিগত না থেকে সাধারণ মানুষের উৎসব হয়ে উঠুক, গত দুবছর ধরেই সে ব্যাপারে সচেষ্ট মুখ্যমন্ত্রী নিজে এবং ছবির নির্বাচন থেকে শুরু করে সব ব্যাপারেই সেই জনমুখী নীতি স্পষ্ট৷ গত বছর যেমন এই প্রতিবেদকের স্বচক্ষে দেখা, রবীন্দ্রসদনে বিখ্যাত এক ফরাসি ছবি দেখতে ভিড় করা মানুষের উদ্দেশ্যে বলা হলো, যাঁরা পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেছেন, তাঁরা আগে ঢুকবেন৷ যাঁদের ডেলিগেট কার্ড, তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে! ভিতরে বসার জায়গা থাকলে তবে তাঁরা ঢুকতে পারবেন! বাইরে তখন ডেলিগেট কার্ডধারীদের মধ্যে বাংলার এই মুহূর্তের সফলতম চিত্র পরিচালক সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে৷ এমন অভাবনীয় ঘটনা কিন্তু তিন বছর আগেও ভাবা যেত না!
অবশ্য কলকাতার চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ কবেই বা আর আসনে বসে উৎসবের ছবি দেখার অভ্যেস করেছে! জায়গা না থাকলে প্রেক্ষাগৃহের মেঝেতে, সিঁড়িতে বসেই দিব্যি দেখা গেছে বিশ্ব চলচ্চিত্র৷ উৎসবের প্রচারে এবার দেখা গেল কলকাতার দর্শকদের সেই ফিল্ম উন্মাদনারই প্রতিফলন৷ এক মাস আগে থেকে কলকাতার হোর্ডিং ছেয়ে গিয়েছিল ‘সিট না থাকলে সিঁড়িতে' বা ‘টিকিট না ডেলিগেট কার্ড?' জাতীয় বিজ্ঞাপনে৷ এবার আরও বেশি পেশাদারিত্ব আনতে দুটি বিজ্ঞাপন সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছে উৎসবের প্রচার ও বিপণন সামলানোর৷ ফলে নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বরে পাওয়া যাচ্ছে বিখ্যাত বাংলা ছবির সংলাপ লেখা টি শার্ট আর কফি মাগ৷ প্রচারের জন্য শহর ঘুরছে কলকাতার মার্কা মারা লাল দোতলা বাস৷
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব যে বিনোদনের পাশাপাশি বাণিজ্যও করতে চায়, সেটা কোনো সংস্কৃতিচর্চার ভনিতা দিয়ে গোপন রাখতে চায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার৷ এবারের উৎসব সেই লক্ষ্যেই আরও দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করেছে৷