বাবা-মা-এর সচেতনতা দরকার
১০ নভেম্বর ২০১৫দু-তিন বছর আগে বেশ ‘শিক্ষিত' এবং ‘আধুনিক' একটি পরিবারের অভিজ্ঞতা বিষয়টি নিয়ে খুব ভাবিয়ে তুলেছিল৷
ঢাকা শহরের ওই পরিবারের কর্তা-কর্ত্রী দু'জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন৷ তাঁদের বড় ছেলে তথাকথিত অভিজাত এলাকার একটি স্কুলে পড়ে৷ ছেলেটির বয়স তখন ৮ অথবা ৯৷ এক দুপুরে ছেলেটি স্কুল থেকে ফিরে বাথরুমে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে মায়ের কাছে জানতে চায়, ‘‘ মা, যৌনমিলন কী?''
কোনো উত্তর নেই৷
‘‘মা, যৌন মিলন কী? কী হলো মা, বলছ না কেন, যৌন মিলন কী?''
মা তখন রান্নাঘরে৷ ছেলের প্রশ্ন তিনি শুনেছেন ঠিকই৷ প্রথমে মনে করেছিলেন ভুল শুনছেন৷ তাই চুপচাপ ছিলেন৷ কিন্তু ছেলে ‘যৌনমিলন কী', ‘যৌনমিলন কী' বলে চিৎকার করে পাড়া প্রায় মাথায় তুলল৷ অগত্যা মা কাজ ফেলে একরকম ছুটেই চলে গেলেন বাথরুমে৷ এমন বিষয়ে তো আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলা যায় না! ছেলেকে এক নজর ভালো করে দেখে মা সসংকচে বললেন, ‘‘এ সব আরো বড় হলে জানতে পারবে৷ এখন এ সব নিয়ে না ভেবে গোসল সেরে খেতে এসো৷''
ছেলে কি আর সে কথা শোনে! সে সগর্বে বলে ওঠে, ‘‘কে বলেছে আমার বয়স হয়নি? জানো, আজ স্কুলে এটা পড়িয়েছে৷'' মা বুঝলেন, কথায় ভোলানো যাবে না, তাই অনেকটা আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতেই বললেন, ‘‘বাবা, আমি তো পুরো বিষয়টা জানি না, জেনে নিই, তারপরে তোমাকে জানাবো৷''
ওইটুকু ছেলে এ বয়সে এমন প্রশ্ন করবে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি৷ স্কুলে এসব পড়ানো শুরু হবে, তা-ও তিনি জানতেন না৷ কিন্তু ছেলে জানতে যখন চেয়েছে কিছু একটা বলতে তো হবেই৷ কী বলবেন? কিভাবে বলবেন? মা হয়ে শিশু সন্তানকে এ সব বলা কি ঠিক হবে? ‘যৌনমিলন কী' – এই এক প্রশ্নে মায়ের মনে তখন হাজারো প্রশ্নের উঁকি৷ এক বান্ধবীকে ফোন করলেন৷ সব শুনে বান্ধবী বললেন, ‘‘ধুর, এটা কি বলা যায় নাকি? তাছাড়া যৌনমিলন কি বলে বোঝানোর বিষয়? ওকে বলে দিন, যৌনশিক্ষার ক্লাস করতে হবে না৷ বলে দিন, আপনি স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলবেন৷''
বান্ধবীর পরামর্শ মনে ধরল না৷ তাই সেই রাতেই ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন৷ স্বামী মহোদয় বুদ্ধিমান৷ সব শুনে দু-দিন বিষয়টি নিয়ে ছেলেকে কিছুই বললেন না৷ ছুটির দিনে ছেলেকে ডেকে শুধু বললেন, ‘‘তুমি নাকি যৌনমিলন সম্পর্কে জানতে চেয়েছো? যৌনমিলন হলো এক ধরণের ভালোবাসা৷ বড় হলে মানুষ ওভাবে ভালোবাসে৷ ওভাবে ভালোবাসলে বাচ্চা হয়৷ এই ভালোবাসার জন্যই তুমি হয়েছো৷''
পরে সেই স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছেলেটিকে ক্লাসে যিনি ‘যৌন শিক্ষা' বিষয়ে পাঠদান করেছিলেন, তিনি পাঠ্যপুস্তকের ওই একটি অধ্যায় একবার পড়ে নেয়া ছাড়া এ বিষয়ে কোনো প্রস্তুতিই নেননি৷ যে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ ‘যৌনশিক্ষা' বিষয়ে প্রায় অজ্ঞ, সেখানে শিক্ষক-শিক্ষিকার হাতে একটা বই তুলে দিলেই হবে? যৌন শিক্ষা, যৌন শিক্ষার প্রয়োজন এবং গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষক এবং অভিবাককদের ধারণাই যদি স্বচ্ছ না হয়, কী লাভ শিশুদের যৌন শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করে?
শেষ কথা
শিশু শিক্ষা, শিশু প্রতিপালন – এ সব সমন্বয়হীন হলে মহাবিপদ৷ উন্নত বিশ্বে শুধু মানুষের সন্তান নয়, যে কোনো প্রাণির ‘শিক্ষা' এবং প্রতিপালনের ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়৷ জার্মানির মতো কিছু দেশে তো কুকুরের জীবনযাপন দেখলেও অবাক হতে হয়৷
এখানে ঘরে ঘরে কুকুর৷ কুকুর পোষা এখানে অনেকটা সংস্কৃতির অংশ৷ তা-ই বলে চাইলেই কেউ কুকুর পুষতে পারেন না৷ আগে কুকুর পোষার ‘যোগ্য' হতে হয়৷ যিনি পুষবেন তাঁর কুকুর পোষার মতো আর্থিক সঙ্গতি এবং ‘মানসিক অবস্থা' আছে কিনা – তা রীতিমতো পরীক্ষা করে দেখা হয়৷ কুকুর পোষার প্রশিক্ষণও নিতে হয় তাঁকে৷ কুকুরের জীবনের মূল্য বুঝতে হয়৷ কুকুরের থাকা-খাওয়া-চিকিৎসার সুব্যবস্থা করতে হয়, স্কুলে পাঠাতে হয়৷ সেখানে কুকুর শেখে, কাউকে দেখলেই ‘ঘেউ, ঘেউ' করে কামড়াতে যাওয়া চলবে না৷ কুকুর কাউকে কামড়ালেই মালিকের মোটা অঙ্কের জরিমানা৷ তাই নিজের স্বার্থেই মালিক প্রিয় পোষা প্রাণীকে স্কুলে নিয়ে যান৷ সেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষাও পায় কুকুর৷
আমরা উন্নত বিশ্বের মতো অনেক কিছু চাই৷ শিক্ষায়ও চাই সেরকম পরিবর্তন৷ চাওয়া মন্দ নয়৷ শুধু চাওয়া-পাওয়ার সম্ভাব্য ব্যবধানটা মনে রাখা দরকার৷ রাজধানীর অভিজাত এলাকার স্কুল, শিক্ষক এবং অভিভাবকই যেখানে শিশুদের ‘যৌনশিক্ষা' সম্পর্কে সচেতন করতে অক্ষম, সেখানে দেশের গড়পড়তা স্কুলের শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা হতে পারে তা তো বোঝাই যায়৷
সন্তানকে যৌনতা সম্পর্কে সচেতন করা কি বাবা-মায়ের কর্তব্য নয়? মতামত জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷