বারোশ’ বছরের পুরনো এক শহর
নাম বললেই গথিক ফ্যানরা লোয়ার স্যাক্সনির এই শহরটিকে চিনবেন৷ আশির দশকে ইংল্যান্ডে ‘পাংক’-পরবর্তী সাবকালচার হিসেবে জন্ম নেয় গথিক কালচার, হিল্ডেসহাইম যার একটি তীর্থ৷ তবে শহরটিতে আরো অনেক কিছু দেখার আছে৷
সাতশ’ বছরের পুরনো গোলাপগাছ
হিল্ডেসহাইমের বড় গির্জাটিতে বসানো এই গোলাপগাছ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমাবাজিতে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু তার কয়েক সপ্তাহ পরেই তাতে আবার পাতা ধরে! সেই গোলাপগাছকে আজ হিল্ডেসহাইমের ট্রেডমার্ক বলা চলে৷
বারোশ’ বছরের পুরনো শহর
হিল্ডেসহাইমের হাজার বছরেরও বেশি দীর্ঘ ইতিহাসে ৪০টির বেশি গির্জা গড়ে উঠেছে, বিশেষ করে রোমানেস্ক শৈলীর ক্যাথিড্রাল অফ সেন্ট মেরি অফ দ্য অ্যাজাম্পসন ও সন্ত মিশায়েলের বাসিলিকা পর্যটকদের মুগ্ধ করে৷ হিল্ডেসহাইমের মধ্যযুগের ইতিহাস আজ এক লাখ বাসিন্দার এই শহরটিকে গির্জা সংক্রান্ত শিল্পকলার কেন্দ্র করে তুলেছে৷
মধ্যযুগের ব্রোঞ্জের দরজা
সেন্ট মেরি অফ দ্য অ্যাজাম্পসন ক্যাথিড্রালের দু’পাল্লার দরজাটি প্রায় পাঁচ মিটার উঁচু এবং সন্ত ও কাল্পনিক জীবজন্তুর নানা মূর্তি দিয়ে সাজানো৷ ১০১৫ সালে এই দরজা ঢালাই করেন হিল্ডেসহাইমের কারিগররা, ১৯৮৫ সাল যাবৎ যা ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত৷ বৃষ্টি-বাদলার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দরজার পাল্লা দু’টি কিন্তু ভিতরদিকে মুখ করে বসানো৷
ছ’মিটার ব্যাসের ঝাড়বাতি
রোমানেস্ক আমলের এই চক্রাকৃতি ঝাড়বাতিটিতে ৭২টি মোমবাতি বসানো যায়৷ সামনে যে ব্যাপটিজম করার ফন্ট বা আধারটি দেখা যাচ্ছে, সেটিও ব্রোঞ্জের এবং গথিক শৈলীর কারুকার্য করা৷
যিশুর হাতেখড়ি!
পঞ্চদশ শতাব্দীর এক ওলন্দাজ ভাস্কর ওক গাছের কাঠ থেকে শিশু যিশুখ্রিষ্টকে কোলে নিয়ে মা মেরির এই মূর্তিটি তৈরি করেন৷ মা মেরির পোশাক যথারীতি নীল রঙের – বিশেষত্ব হলো এই যে, মা মেরি হাতে দোয়াত ধরে রয়েছেন; ওদিকে শিশু যিশুর হাতে হাঁসের পালকের কলম৷
গণিতজ্ঞদের গির্জা
হিল্ডেসহাইমে সন্ত মিশায়েলের বাসিলিকাটি নাকি পুরোপুরি অঙ্কশাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী গড়া৷ সব কিছুর অনুপাত, দূরত্ব বা পর্যায়ক্রম নাকি ‘ফর্মুলা’ ধরে৷ ওদিকে গির্জার ভিতরে এমন একটি ‘আশ্চর্য’ রয়েছে যে, ইউনেস্কোর এই বাসিলিকাটিকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা ছাড়া উপায় ছিল না৷
কাঠের ওপর আঁকা ছাদ
সন্ত মিশায়েলের বাসিলিকার ভিতরে একটি ৩০ মিটার লম্বা ও ৯ মিটার চওড়া কাঠের ছাদ রয়েছে, যা পুরোপুরি অঙ্কণকার্যে ভরা –মোট ২৪২ বর্গমিটার কারুকার্য৷ এই ছাদ তৈরি করতে নাকি ১,৩০০ ওক গাছের গুঁড়ি লেগেছিল৷ মজার কথা, সেই সব গাছের গুঁড়ি নাকি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কাটা হয়েছিল৷
বাইবেলের কাহিনি
সন্ত মিশায়েলের বাসিলিকার ছাদে আঁকা ক্ষেত্রটি আট ভাগে ভাগ করা, তার মধ্যে সাতটি পুরোপুরি অক্ষত আছে৷ এই ক্ষেত্রগুলিতে বাইবেলের অনেক কাহিনি ছবির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, যেমন অ্যাডাম ও ইভের কাহিনি৷ মধ্যযুগের সেই মহান শিল্পীরা কোথাও নিজেদের নাম লিখে যাননি৷ জমি থেকে সাড়ে ষোলো মিটার উচ্চতায় তাঁদের অসাধারণ শিল্পকর্ম দেখতে বাইনোকুলার নিয়ে যাওয়াই ভালো৷
গথিক, ওয়েভ, মেটাল...
হিল্ডেসহাইমের ‘‘মে’রা লুনা’’ ফেস্টিভ্যালে এসব সংগীতের নমুনা উপভোগ করা যায়৷ গথিক ফ্যানরা ভুতুড়ে ব্যাপার-স্যাপার ভালোবাসেন; মৃত্যু কিংবা নশ্বরতার মতো বিষয় নাকি তাঁদের মুগ্ধ করে৷ কাজেই মড়ার মতো সাদা রং আর প্লেগ রোগের মতো কালো কাজল না পরলে গথিক ফ্যানদের চলে না – যেন মধ্যযুগের সঙ্গে পাংক, ফ্যানটাসি আর মাংগার মিশ্রণ ঘটেছে৷
দ্যাখো ও দ্যাখাও
গথিকই হোক আর রেনেসাঁসই হোক, সাজগোজ মানেই লোককে দেখানো এবং নিজে দেখা৷ সেই হিসেবে গথিক ফেস্টিভ্যালে যাওয়া আর শাদিবাড়িতে যাওয়ার মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই৷ মেক-আপ থেকে শুরু করে সাজপোশাক বা অলংকার, সবই মেলায় কিনতে পাওয়া যায়, এমনকি একটি ফ্যাশন প্যারেডেরও ব্যবস্থা আছে৷
‘মে’রা লুনা’
হিল্ডেসহাইমের ‘মে’রা লুনা’ মিউজিক ফেস্টিভ্যালের নামটা কাল্পনিক, সব ভাষাতেই নাকি তার মানে বোঝা যাবে৷ তবে ২৫,০০০ দর্শকের এই ফেস্টিভ্যালটি পপ সংগীতের গথিক, ওয়েভ, মেটাল ইত্যাদি ধারার জন্য ইউরোপের বৃহত্তম ফেস্টিভ্যালগুলির মধ্যে পড়ে৷
যুদ্ধ ও শান্তি, আধুনিকতা ও ইতিহাস
সন্ধ্যার নরম আলোয় হিল্ডেসহাইমের মধ্যযুগীয় বাজার এলাকার ফোয়ারাটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়, মধ্যযুগ যেন আধুনিকতার কাছে কুটুম্বিতা করতে এসেছে৷